২১০৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১০৯
عَنْ عُثْمَانَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «خَيْرُكُمْ مَنْ تَعْلَّمَ الْقُرْاٰنَ وَعَلَّمَه». رَوَاهُ البُخَارِىُّ
উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম, যে কুরআন শিক্ষা করে এবং তা (মানুষকে) শিক্ষা দেয়। (বুখারী)[১]
অত্র হাদীসে বলা হয়েছে যে, কুরআন শিক্ষা করে এবং (অপরকে) শিক্ষা দেয়। কোন কোন বর্ণনায় و ‘ওয়াও’ (এবং) এর পরিবর্তে اَوْ ‘আও’ (অথবা) ব্যবহার করা হয়েছে; তখন হাদীসের অর্থ হয় যে কুরআন শিক্ষা করে অথবা অপরকে শিক্ষা দেয়...। শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেয়া প্রত্যেকটি কাজই উত্তম তবে যে উভয়টি করে সে সর্বোত্তম। কুরআন হলো আশরাফুল ‘উলূম বা অধিক মর্যাদাসম্পন্ন বিদ্যা, তা যে শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয় স্বভাবতই সে অন্য সকল বিদ্বান থেকে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি।
মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, এ হাদীস থেকে এ ধারণা করা ঠিক নয় যে, ‘আমাল এর বাইরে, অর্থাৎ- কুরআন অনুযায়ী ‘আমালের কোন প্রয়োজন নেই শুধু তা শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেয়াতেই এ মর্যাদা পাওয়া যাবে। বরং যিনি কুরআন শিক্ষা গ্রহণ ও প্রদানের সাথে সাথে সে অনুযায়ী ‘আমাল করবেন তিনিই কেবল এই মর্যাদা পাবেন। ‘আমালবিহীন ‘আলিম জাহিলের মতই।
২১১০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১১০
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ: خَرَجَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ وَنَحْنُ فِى الصُّفَّةِ فَقَالَ: «أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَغْدُوَ كُلَّ يَوْم إِلٰى بُطْحَانَ أَو الْعَقِيْقَ فَيَأْتِىْ مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ فِىْ غَيْرِ إِثْمٍ وَلَا قَطْعِ رَحِمٍ» فَقُلْنَا يَا رَسُول الله نُحِبُّ ذٰلِكَ قَالَ: «أَفَلَا يَغْدُوْ أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمُ أَوْ يَقْرَأُ اٰيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللهِ خَيْرٌ لَه مِنْ نَاقَتَيْنِ وَثَلَاثٍ خَيْرٌ لَه مِنْ ثَلَاثٍ وَأَرْبَعٍ خَيْرٌ لَه مِنْ أَرْبَعٍ وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الْإِبِلِ». رَوَاهُ مُسْلِمٌ
উকবাহ্ ইবনু ‘আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা (একদিন) মাসজিদের প্রাঙ্গণে বসেছিলাম। এ সময়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে আসলেন ও (আমাদেরকে) বললেন, তোমাদের কেউ প্রতিদিন সকালে ‘বুত্বহান’ অথবা ‘আক্বীক’ বাজারে গিয়ে দু’টি বড় কুঁজওয়ালা উটনী কোন অপরাধ সংঘটন ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ছাড়া নিয়ে আসতে পছন্দ করবে? এ কথা শুনে আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের প্রত্যেকেই এ কাজ করতে পছন্দ করবে। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ যদি তা-ই হয় তাহলে তোমাদের কেউ কোন মাসজিদে গিয়ে সকালে আল্লাহর কিতাবের দু’টি আয়াত (মানুষকে) শিক্ষা দেয় না বা (নিজে) শিক্ষাগ্রহণ করে না কেন? অথচ এ দু’টি আয়াত শিক্ষা দেয়া তার জন্য দু’টি উটনী অথবা তিনটি আয়াত শিক্ষা দেয়া তার জন্য তিনটি উটনী অথবা চারটি আয়াত শিক্ষা দেয়া তার জন্য চারটি উটনীর চেয়েও উত্তম। সারকথা কুরআনের যে কোন সংখ্যক আয়াত, একই সংখ্যক উটনীর চেয়ে উত্তম। (মুসলিম)[১]
মাসজিদে গিয়ে কুরআন শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেয়ার সাওয়াব ‘আরবের ঐ উঁচু কুঁজ বিশিষ্ট লাল উটের মূল্যের চেয়েও অধিক বেশি, এমনকি প্রতিটি আয়াতের বিনিময় একটি করে উটের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং যে যত আয়াত পড়বে বা পড়াবে সে তত বেশি উটের মালিক হবে। এর অর্থ ঐ উট সদাকাহ্ করলে যে সাওয়াব মিলবে তা সে পাবে।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এটা উৎসাহব্যঞ্জক একটি দৃষ্টান্তমূলক কথা যাতে মানুষ এ কাজে অনুপ্রাণিত হয়। অন্যথায় কুরআন মাজীদের একটি আয়াতের মারেফাতের তুলনায় গোটা পৃথিবী তুচ্ছ।
২১১১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১১১
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ إِذَا رَجَعَ إِلٰى أَهْلِه أَنْ يَجِدَ فِيهِ ثَلَاثَ خَلِفَاتٍ عِظَامٍ سِمَانٍ». قُلْنَا: نَعَمْ. قَالَ: «فَثَلَاثُ اٰيَاتٍ يَقْرَأُ بِهِنَّ أَحَدُكُمْ فِىْ صلَاتِه خَيْرٌ لَه مِنْ ثَلَاثِ خَلِفَاتٍ عِظَامٍ سِمَانٍ». رَوَاهُ مُسْلِمٌ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ কি নিজ ঘরে ফিরে তিনটি মোটাতাজা গর্ভবতী উটনী পেতে পছন্দ করো? আমরা বললাম, (হে আল্লাহর রসূল!) নিশ্চয়ই পছন্দ করি। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তাহলে তারা যেন সলাতে তিনটি আয়াত পড়ে। এ তিনটি আয়াত তার জন্য তিনটি মোটাতাজা গর্ভবতী উটনী অপেক্ষা উত্তম। (মুসলিম)[১]
২১১২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১১২
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهَا قَالَتْ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «الْمَاهِرُ بِالْقُرْاٰنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِىْ يَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَه أَجْرَانِ». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআন অধ্যয়নে পারদর্শী ব্যক্তি মর্যাদাবান লিপিকার মালায়িকাহ্’র (ফেরেশ্তাগণের) সাথী হবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করে ও যে এতে আটকে যায় এবং কুরআন তার জন্য কষ্টদায়ক হয়, তাহলে তার জন্য দু’টি পুরস্কার। (বুখারী, মুসলিম)[১]
(سفرة الْكرام) হলো লেখার কাজে দায়িত্বশীল সম্মানিত দূত। তারা আল্লাহর রিসালাত নিয়ে মানুষের কাছে সফর করে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) (ফেরেশতামন্ডলী) যারা লাওহে মাহফূয বা সংরক্ষিত ফলক বহন করে থাকেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, এটা এমন সহীফায় লিপিবদ্ধ যা সম্মানিত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পবিত্র, সুসম্মানিত ও নেককার লেখকের হাতে থাকে। (সূরা ‘আবাসা ৮০ : ১৩-১৬)
মোটকথা ভাল কুরআন তিলাওয়াতকারী মানব কল্যাণে অবতীর্ণ সম্মানিত বিশেষ মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)’র (ফেরেশতামন্ডলীর) সাথে বন্ধু হিসেবে থাকবেন অথবা ঐ মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)’র মর্যাদা লাভ করবেন। অথবা তারা এমন মর্যাদার স্থান লাভ করবেন যেখানে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) তাদের বন্ধু হিসেবে থাকবেন।
পক্ষান্তরে কুরআনের উপর দক্ষতা না থাকার কারণে যারা থেমে থেমে কষ্ট করে তিলাওয়াত করবে তাদের সাওয়াব দ্বিগুণ হবে। একটি পাঠের জন্য অপরটি হলো কষ্টের জন্য। এটাও কষ্ট করে করে কুরআনুল কারীম শিক্ষার ক্ষেত্রে উৎসাহব্যঞ্জক কথা।
তাই বলে কুরআনের প্রাজ্ঞ ব্যক্তির চেয়ে সে কোনক্রমেই উত্তম নয়। কেননা প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের অবস্থান হবে অতীব উন্নত ও সম্মানিত মালায়িকাহর সাথে এবং তাদের সাওয়াব হবে বহু গুণে উন্নীত। ইবনুত্ তীন সহ অনেকে বলেন, এদের মর্যাদা এত বেশি গুণে উন্নীত যে, তা গুণে শেষ করা যাবে না। ‘আল্লামা কুসতুলানী বলেন, কুরআনের দক্ষ ব্যক্তির দক্ষতা অর্জন করতেও অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। সুতরাং তার মর্যাদা বেশিই হওয়া স্বাভাবিক।
২১১৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১১৩
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «لَا حَسَدَ إِلَّا عَلٰى اِثْنَيْنِ: رَجُلٌ اٰتَاهُ اللّٰهُ الْقُرْاٰنَ فَهُوَ يَقُومُ بِه اٰنَاءَ اللَّيْلِ وَاٰنَاءَ النَّهَارِ وَرَجُلٌ اٰتَاهُ اللّٰهُ مَالًا فَهُوَ يُنْفِقُ مِنْهُ اٰنَاءَ اللَّيْلِ وَاٰنَاءَ النَّهَارِ». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দু’টি ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ে ঈর্ষা করা যায় না। প্রথম, সে ব্যক্তি যাকে আল্লাহ কুরআনের (‘ইলম) দান করেছেন, আর সে তা দিন-রাত অধ্যয়ন করে। দ্বিতীয়, ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং তা সে সকাল সন্ধ্যায় দান করে। (বুখারী, মুসলিম)[১]
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, ‘উলামাগণ হাসাদ-কে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন।
১. হাক্বীক্বী বা বাস্তবিক এবং
২. মাজাযী বা রূপক।
হাক্বীক্বী বা বাস্তবটির অর্থ হলো হিংসা, যা হারাম, পক্ষান্তরে মাজাযী বা রূপকটির অর্থ হলো গিবত্বাহ্ বা ঈর্ষা, যা বৈধ, এমনকি কখনো তা প্রশংসনীয়।
অত্র হাদীসে যে হাসাদ-এর কথা বলা হয়েছে সেটি হলো ‘হাসাদ’ শব্দের রূপক অর্থ, অর্থাৎ- গিবত্বাহ্ বা ঈর্ষা। এটা কোন কোন বিষয়ে প্রশংসনীয়, তবে কোন খারাপ কাজে এটা বৈধ নয়।
যেমন সহীহুল বুখারীতে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, তিনি তার এক প্রতিবেশীকে বলতে শুনেছেন, আফসোস! যদি আমাকে অমুকের মতো কুরআন দান করা হতো তাহলে সে যেমন ‘আমাল করে আমিও অনুরূপ ‘আমাল করতাম।
দু’জন ব্যক্তি বলতে দু’টি বৈশিষ্ট্য। কুরআন নিয়ে দন্ডায়মান হওয়ার অর্থ হলো কুরআন মুখস্থ করা, তা তিলাওয়াত করা, (চাই সলাতে হোক, চাই সলাতের বাইরে হোক) তা অপরকে শিক্ষা দেয়া এবং তার হুকুম মোতাবেক ‘আমাল করা। দ্বিতীয় সম্পদশালী ব্যক্তি সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয়ের ব্যাপারে দিবা-রাতের কোন পরোয়া করে না, বরং সদা-সর্বদা সে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে থাকে। আহমাদ-এর বর্ণনায় হাক্বের পথে ব্যয়ের কথা বলা আছে। দিনে রাতে ব্যয় করার অর্থ এও হতে পারে প্রকাশ্যে এবং গোপনে দান করা।
২১১৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১১৪
وَعَنْ أَبِىْ مُوسَى الْأَشْعَرِىِّ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَثَلُ الْمُؤمِنِ الَّذِىْ يَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ مَثَلُ الْأُتْرُجَّةِ رِيْحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ وَمَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِىْ لَا يقْرَأُ الْقُرْاٰنَ مَثَلُ الْتَّمَرَةِ لَا رِيْحَ لَهَا وَطُعْمُهَا حُلْوٌ وَمَثَلُ الْمُنَافِقِ الَّذِىْ لَا يَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ كَمَثَلِ الْحَنْظَلَةِ لَيْسَ لَهَا رِيحٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ وَمَثَلُ الْمُنَافِقِ الَّذِىْ يقْرَأُ الْقُرْاٰنَ مَثَلُ الرَّيْحَانَةِ رِيْحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا مَرٌّ». مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ. وَفِىْ رِوَايَةٍ: «الْمُؤْمِنُ الَّذِىْ يَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ وَيَعْمَلُ بِه كَالْأُتْرُجَّةِ وَالْمُؤْمِنُ الَّذِىْ لَا يَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ وَيَعْمَلُ بِه كَالتَّمْرَةِ
আবূ মূসা আল আশ্‘আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআন পাঠকারী মু’মিনের দৃষ্টান্ত হলো তুরঞ্জ ফল বা কমলা লেবুর ন্যায়। যার গন্ধ ভাল, স্বাদও উত্তম। যে মু’মিন কুরআন পড়ে না, তার দৃষ্টান্ত হলো খেজুরের ন্যায়। এর কোন গন্ধ নেই বটে, কিন্তু উত্তম স্বাদ আছে। কুরআন পাঠ করে না যে মুনাফিক, সে হানাযালাহ্ (তিতা) ফলের মতো, যার কোন গন্ধ নেই অথচ স্বাদ তিতা। আর ওই মুনাফিক যে কুরআন পড়ে তার দৃষ্টান্ত ঐ ফুলের মতো, যার গন্ধ আছে কিন্তু স্বাদ তিতা। (বুখারী, মুসলিম।)
অন্য এক বর্ণনায় আছে, যে মু’মিন, কুরআন পড়ে ও সে অনুযায়ী ‘আমাল করে সে কমলা লেবুর মতো। আর যে মু’মিন কুরআন পড়ে না, কিন্তু এর উপর ‘আমাল করে সে খেজুরের মতো।)[১]
হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, অন্য কোন ফলের নাম উল্লেখ না করে উতরুজ্জাহ্ ফলের নাম উল্লেখ করার হিকমাত হলো এর ছাল দিয়ে ঔষধ তৈরি হয়, বীজ থেকে নানা উপকারী তৈল বের করা হয়। বলা হয় যে বাড়িতে তুরঞ্জ ফল থাকে সে বাড়িতে জিন্ প্রবেশ করতে পারে না। ওর বীজের উপরের পাতলা আবরণীর সম্পর্ক হলো মু’মিনের কলবের ন্যায়। এছাড়াও ওর বহুবিধ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
ঈমানের বিশেষণ খাদ্যের সাথে আর কুরআন তিলাওয়াতের বিশেষণ সুগন্ধির সাথে সাদৃশ্যযুক্ত করা হয়েছে। কেননা ঈমান মু’মিনকে কুরআন ধারণে বাধ্য করে যদিও ঈমান অর্জন কুরআন তিলাওয়াত ছাড়াও সম্ভব। অথবা ঈমানকে সুগন্ধযুক্ত খাদ্যের সাথে সাদৃশ্য দেয়া হয়েছে এজন্য যে, ঈমানের কল্যাণটা হলোঃ আত্মিক, প্রত্যেকের কাছে তা প্রকাশিত হয় না, কিন্তু কুরআন তিলাওয়াতের সুগন্ধি দ্বারা সকলেই উপকৃত হয়। প্রতিটি শ্রোতাই প্রকাশ্যভাবে এর সৌন্দর্যে আপ্লুত হয়।
মাযহারী বলেন, কুরআন তিলাওয়াতকারী মু’মিনের দৃষ্টান্ত এরূপ যে, তার দৃঢ় ঈমান স্বীয় অন্তরে সুগন্ধি ছড়ায়, আর সে যখন কুরআন তিলাওয়াত করে তখন তার সম্মোহনী সুর লহরীতে মানুষ প্রশান্তি লাভ করে। শ্রোতা কুরআন শুনে সাওয়াব অর্জন করে এবং সেখান থেকে শিক্ষা লাভ করে। এটাই হলো তুরঞ্জ ফলের দৃষ্টান্ত যার স্বাদও সুন্দর গন্ধও সুন্দর।
২১১৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১১৫
وَعَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «إِنَّ اللهَ يَرْفَعُ بِهٰذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِه اٰخَرِينَ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
‘উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাব কুরআনের মাধ্যমে কোন কোন জাতিকে উন্নতি দান করেন। আবার অন্যদেরকে করেন অবনত। (মুসলিম)[১]
২১১৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১১৬
وَعَنْ أَبِىْ سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ أَنَّ أُسَيْدَ بنَ حُضَيْرٍ قَالَ: بَيْنَمَا هُوَ يَقْرَأُ مِنَ اللَّيْلِ سُورَةَ الْبَقَرَةِ وَفَرَسُه مَرْبُوطَةٌ عِنْدَه إِذْ جَالَتِ الْفَرَسُ فَسَكَتَ فَسَكَتَتْ فَقَرَأَ فَجَالَتِ الْفَرَسُ فَسَكَتْ فَسَكَنَتْ، ثُمَّ قَرَأَ فَجَالَتِ الْفَرَسُ فَانْصَرَفَ وَكَانَ ابْنُه يَحْيٰى قَرِيْبًا مِنْهَا فأَشْفَقَ أَنْ تُصِيْبَه فَلَمَّا أَخَّرَه رَفَعَ رَأْسَه إِلَى السَّمَاءِ فَإِذَا مِثْلُ الظُّلَّةِ فِيهَا أَمْثَالُ الْمَصَابِيحِ فَلَمَّا أَصْبَحَ حَدَّثَ النَّبِىَّ ﷺ فَقَالَ: «اِقْرَأْ يَا ابْنَ حُضَيْرٍ اقْرَأْ يَا ابْنَ حُضَيْرٍ». قَالَ فَأَشْفَقْتُ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ أَنْ تَطَأَ يَحْيٰى وَكَانَ مِنْهَا قَرِيْبًا فَانْصَرَفْتُ إِلَيْهِ وَرَفَعْتُ رَأْسِىْ إِلَى السَّمَاءِ فَإِذَا مِثْلُ الظُّلَّةِ فِيهَا أَمْثَالُ الْمَصَابِيحِ فَخَرَجَتْ حَتّٰى لَا أَرَاهَا قَالَ: «وَتَدْرِىْ مَا ذَاكَ؟» قَالَ لَا قَالَ: «تِلْكَ الْمَلَائِكَةُ دَنَتْ لِصَوْتِكَ وَلَوْ قَرَأْتَ لَأَصْبَحَتْ يَنْظُرُ النَّاسُ إِلَيْهَا لَا تَتَوَارٰى مِنْهُمْ». مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ. وَاللَّفْظُ لِلْبُخَارِىِّ وَفِىْ مُسْلِمٍ: «عَرَجَتْ فِى الْجَوِّ» بَدَلَ: «فَخَرَجْتُ عَلٰى صِيغَةِ الْمُتَكَلِّمِ
আবূ সা‘ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
উসায়দ ইবনু হুযায়র (রাঃ) বলেন, এক রাতে তিনি সূরা আল বাকারাহ্ পড়ছিলেন। তাঁর ঘোড়া তাঁর কাছেই বাঁধা ছিল। হঠাৎ ঘোড়াটি লাফিয়ে উঠল। তিনি ঘোড়াটিকে চুপ করালেন। ঘোড়াটি চুপ হলো। তিনি আবার পড়তে লাগলেন। ঘোড়াটি আবার লাফিয়ে উঠল। তিনি ঘোড়াটিকে শান্ত করলেন। আবার পড়তে লাগলেন। আবার ঘোড়াটি লাফিয়ে উঠল। এবার তিনি থেমে গেলেন। কারণ তখন তাঁর ছেলে ইয়াহ্ইয়া ঘোড়াটির কাছাকাছি ছিল। তিনি ওর ক্ষতির আশংকা করলেন। তারপর তিনি তাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে মাথা উঠালেন। দেখলেন, (আকাশে) সামিয়ানার মতো (কি একটা ঝুলছে)। আর এতে যেন অনেক বাতি রয়েছে। ভোরে উঠে তিনি তা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানালেন।
(ঘটনা) শুনে তিনি বললেন, তুমি পড়তে থাকলে না কেন ইবনু হুযায়র? তুমি পড়তে থাকলে না কেন? ইবনু হুযায়র বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমার ঘোড়া ইয়াহ্ইয়া-কে মাড়িয়ে দেবার ভয় করছিলাম। সে ছিল ঘোড়াটির কাছাকাছি। তাই পড়া বন্ধ করে তার কাছে গেলাম। আবার আকাশের দিকে মাথা উঠালাম। দেখলাম, সামিয়ানার মতো, এতে প্রদীপের মতো কিছু আছে। তারপর আমি ওখান থেকে বের হলাম। আর তা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
(এসব) শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এসব কি ছিল জানো? উসায়দ বললেন, জি না, হে আল্লাহর রসূল! তিনি বললেন, এটা ছিল মালায়িকাহর (ফেরেশতাগণের) দল। তাঁরা তোমার তিলাওয়াত শুনে তোমার নিকটবর্তী হচ্ছিলেন। তুমি যদি পড়তে থাকতে, ভোর পর্যন্ত তাঁরা ওখানে থাকতেন। লোকেরা তাঁদেরকে দেখতে পেত। মানুষ হতে তাঁরা লুকিয়ে থাকত না। (বুখারী, মুসলিম। তবে মতন বুখারীর। মুসলিম-এর বর্ণনায় রয়েছে, ‘সামিয়ানা শূন্যে উঠে গেল,’ ‘আমি বের হলাম’-এর স্থলে।)[১]
মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) বলেছেন, আল কুরআনের আস্বাদনের (আনন্দে) ঘোড়া লাফালাফি শুরু করত, তিলাওয়াত বন্ধ করলে সে ঐ স্বাদ হারিয়ে নীরব হয়ে যেত।
সাহাবী উসায়দ তিন তিনবার এটা প্রত্যক্ষ করলেন, অতঃপর শেষবার আকাশ পানে তাকিয়ে দেখেন সামিয়ানার ন্যায় যাতে রয়েছে অসংখ্য বাতি। কোন কোন বর্ণনায় সামিয়ানার পরিবর্তে মেঘের আবরণ বা ছায়ার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। ইবনুল বাত্ত্বাল (রহঃ) বলেন, দৃশ্যত ঐ মেঘের আবরণের ন্যায় যা ছিল মূলত তা ছিল সাকীনাহ্ এবং ওর মধ্যে ছিল মালাক (ফেরেশতা)।
তিলাওয়াত বন্ধ না করলে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন না, আর ঐ বাড়িতে সাকীনাহ্ বর্ষণ হতেই থাকতো।
২১১৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১১৭
وَعَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ قَالَ: كَانَ رَجُلٌ يَقْرَأُ سُورَةَ الْكَهْفِ وَإِلٰى جَانِبِه حِصَانٌ مَرْبُوطٌ بِشَطَنَيْنِ فَتَغَشَّتْهُ سَحَابَةٌ فَجَعَلَتْ تَدْنُوْ وَتَدْنُوْ وَجَعَلَ فَرَسُه يَنْفِرُ فَلَمَّا أَصْبَحَ أَتَى النَّبِىَّ ﷺ فَذَكَرَ ذٰلِكَ لَه فَقَالَ: «تِلْكَ السَّكِيْنَةُ تَنَزَّلَتْ بِالْقُرْاٰنِ». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, এক ব্যক্তি সূরা ‘আল কাহাফ’ পড়ছিল। দু’টি রশি দিয়ে তার ঘোড়া পাশেই বাঁধা ছিল। এমন সময় এক খণ্ড মেঘ তাকে ঢেকে নিলো। মেঘখণ্ডটি ধীরে ধীরে তার নিকটতর হতে লাগল। আর তার ঘোড়াটি লাফাতে লাগল। সে ভোরে উঠে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে এ ঘটনা তাঁকে জানাল। (তিনি ঘটনা শুনে) বললেন, এটা ছিল রহমত, যা কুরআনের কারণে নেমে এসেছিল। (বুখারী, মুসলিম)[১]
হাফেয ইবনু হাজার বলেনঃ এই ঘটনাটির সাদৃশ্যতা রয়েছে। সাবিত বিন কায়স বিন সাম্মাস-এর ঘটনার সাথে। তবে সেটা ঘটেছিল সূরা আল বাকারাহ্ পাঠকালে। ইমাম আবূ দাঊদ-এর মুরসাল রিওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সম্ভবত আস্ওয়াদ বিন হুযায়র সূরা আল বাকারাহ্ পাঠ করেছিলেন। অতঃপর আস্ওয়াদ বিন হুযায়র-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ আমি সূরা আল বাকারাহ্ পাঠ করেছিলাম। সম্ভবত তিনি সূরা আল বাকারাহ্ ও আল কাহাফ উভয়টি পাঠ করেছিলেন; অথবা দু’টোর যে কোন একটি পাঠ করেছিলেন।
২১১৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১১৮
وَعَنْ أَبِىْ سَعِيدٍ بْنِ الْمُعَلّٰى قَالَ: كُنْتُ أُصَلِّىْ فِى الْمَسْجِدِ فَدَعَانِى النَّبِىُّ ﷺ فَلَمْ أُجِبْهُ حَتّٰى صَلَّيْتَ ثُمَّ أَتَيْتُه. فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ إِنِّىْ كُنْتُ أُصَلِّىْ فَقَالَ أَلَمْ يَقُلِ اللّٰهُ (اسْتَجِيبُوا لِلّٰهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دعَاكُمْ). ثُمَّ قَالَ : «أَلَا أُعَلِّمُكَ أَعْظَمَ سُورَةٍ فِى الْقُرْاٰنِ قَبْلَ أَنْ تَخْرُجَ مِنَ الْمَسْجِدِ». فَأَخَذَ بِيَدِىْ فَلَمَّا أَرَدْنَا أَنْ نَخْرُجَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ! إِنَّكَ قُلْتَ لَأُعَلِّمَنَّكَ أَعْظَمَ سُورَةٍ مِنَ الْقُرْاٰنِ قَالَ: ﴿الْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ﴾. هِىَ السَّبْعُ الْمَثَانِىْ وَالْقُرْاٰنُ الْعَظِيمُ الَّذِىْ أُوتِيْتُه. رَوَاهُ البُخَارِىُّ
আবূ সা‘ঈদ ইবনু মু‘আল্লা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
বলেন, মাসজিদে আমি সলাত আদায় করছিলাম। এ সময় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলেন। সলাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি উত্তর দিলাম না। এরপর আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি সলাত আদায় করছিলাম। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আল্লাহ কি এ কথা বলেননি যে, যখন আল্লাহ ও আল্লাহর রসূল ডাকেন তখন তাঁদের ডাকের জবাব দাও? অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, মাসজিদ হতে বের হবার আগে আমি কি তোমাকে (পড়ার জন্য) শ্রেষ্ঠতর সূরাটি শিখাব না?
এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার হাত ধরলেন। তারপর আমরা মাসজিদ হতে বের হতে চাইলে, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনি তো বলেছিলেন, ‘‘আমি কি তোমাকে কুরআনের শ্রেষ্ঠ সূরা শিখাব না?’’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটি হলো সূরা ‘‘আলহামদু লিল্লা-হি রব্বিল ‘আ-লামীন’’। এ সূরাই (পুনঃ পুনঃ আবৃত্ত) সে সাতটি আয়াত (সাব্‘উল মাসানী) ও মহা কুরআন, যা আমাকে দেয়া হয়েছে। (বুখারী)[১]
আল্লাহ ও তার রসূলের আহবানে সাড়া দেয়ার অর্থ হলো তার আনুগত্য করা এবং হুকুম পালন করা।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরাটি শিক্ষা দানের কথা বলেছেন। এর দ্বারা উত্তমটি বুঝানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এর দ্বারা অধিক সাওয়াবের কথা বুঝানো হয়েছে।
ইবনুত্ তীন বলেন, বড় সূরার অর্থ হলো, এর সাওয়াব অন্য যে কোন সূরা হতে বেশি। ‘আল্লামা ত্বীবী বলেন, এটা ঐ সূরার বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, যা অন্য কোন সূরার মধ্যে নেই। আর এ সূরায় রয়েছে বহুবিধ উপকারিতা ও অর্থ। এর দ্বারা কুরআনের এক অংশ অপর অংশের উপর ফাযীলাত বা মর্যাদার কথাও স্বীকৃত।
মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, সূরা ফাতিহাকে আল কুরআনের বড় সূরা বলার কারণ হলো এতে রয়েছে আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা, তার আদেশ নিষেধ পালনের অঙ্গীকার ও তারই জন্য ‘ইবাদাতকে খালেসভাবে পেশ করার স্বীকৃতি। সৌভাগ্যের বস্ত্ত তার কাছেই চাওয়া এবং দুর্ভাগ্যের অবস্থান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করার মহান শিক্ষা। আল কুরআনের সার্বিক মৌলিক আলোচনা এ সূরাতেই নিহীত, সুতরাং এটি সবচেয়ে বড় সূরা।
এ সূরাকে সাব্‘উল মাসানী বলা হয়েছে, (সূরা আল হিজর-এর ৮৭ নং দেখুন)। এর অর্থ পুনঃপঠিতব্য সাত আয়াত বিশিষ্ট সূরা, যেহেতু এ সূরাটি প্রতি রাক্‘আতেই প্রতি সলাতেই পাঠ করা হয়। অথবা এ সূরাটি একের পর এক, অর্থাৎ- দু’বার নাযিল হয়েছে, তাই এর নাম সাব্‘উল মাসানী।
২১১৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১১৯
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «لَا تَجْعَلُوا بِيُوتَكُمْ مَقَابِرَ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِىْ يَقْرَأُ فِيهِ سُوْرَةَ الْبَقَرَةِ». رَوَاهُ مُسْلِمٌ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের ঘরগুলোকে কবরস্থানে পরিণত করো না। (এগুলোতে কুরআন তিলাওয়াত করো) কারণ যেসব ঘরে সূরা আল বাকারাহ্ তিলাওয়াত করা হয় সে ঘর হতে শয়তান ভেগে যায়। (মুসলিম)[১]
এ হাদীসে বলা হয়েছে সূরা আল বাকারাহ্ যে ঘরে তিলাওয়াত করা হয় সে ঘর থেকে শয়তান পালায়। তিরমিযীর এক বর্ণনায় এসেছে, শয়তান সে ঘরে প্রবেশ করতে পারে না।
ইবনু হিব্বান-এর এক বর্ণনায় এসেছে, রাতে যে ঘরে সূরা আল বাকারাহ্ তিলাওয়াত করা হয় তিন রাত পর্যন্ত শয়তান সে ঘরে প্রবেশ করতে পারে না। আর দিনে তিলাওয়াত করলে তিন দিন পর্যন্ত শয়তান সে ঘরে প্রবেশ করতে পারে না।
সূরা আল বাকারাহ্’র এ বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও ফাযীলাত এর বৃহত্তের কারণে এবং এ সূরার মধ্যে আল্লাহর নামসমূহ বেশি ব্যবহার হওয়ার কারণে। আর এ সূরাতে দ্বীনের আহকাম বেশি আছে সে কারণেও। বলা হয় এতে এক হাজার আদেশ এক হাজার নিষেধ, এক হাজার হুকুম এবং এক হাজার খবর রয়েছে।
২১২০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১২০
عَنْ أَبِىْ أُمَامَةَ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ يَقُول: «اقْرَءُوا الْقُرْاٰنَ فَإِنَّه يَأْتِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ اقْرَءُوا الزَّهْرَاوَيْنِ الْبَقَرَةَ وَسُورَةَ اٰلِ عِمْرَانَ فَإِنَّهُمَا تَأْتِيَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ أَوْ كَأَنَّهُمَا غَيَايَتَانِ أَو فِرْقَانِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ تُحَاجَّانِ عَنْ أَصْحَابِهِمَا اقْرَءُوا سُورَةَ الْبَقَرَةِ فَإِنَّ أَخْذَهَا بَرَكَةٌ وَتَرْكَهَا حَسْرَةٌ وَلَا تَسْتَطِيْعُهَا الْبَطَلَةُ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
আবূ উমামাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআন পড়। কারণ কুরআন পাঠ কিয়ামাতের দিন তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশকারী হয়ে আসবে। তোমরা দু’ উজ্জ্বল সূরা আল বাকারাহ্ ও আ-লি ‘ইমরান পড়বে। কেননা কিয়ামাতের দিন এ সূরা দু’টি মেঘখণ্ড অথবা দু’টি সামিয়ানা অথবা দু’টি পক্ষ প্রসারিত পাখির ঝাঁকরূপে আসবে। এ দু’ সূরার পাঠকদের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে। বিশেষ করে তোমরা সূরা আল বাকারাহ্ পড়বে। কারণ সূরা আল বাকারাহ্ পড়া বারাকাত আর তা না পড়া আক্ষেপ। এ সূরা দু’টি পড়তে পারবে না অলস বেকুবরা। (মুসলিম)[১]
এ দু’টি সূরাকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে এজন্য যে, এর হিদায়াত এবং সাওয়াব খুব বেশি ও বড়। যেন তা আল্লাহর নিকট অন্যান্য সূরার তুলনায় সমগ্র তারকার মধ্যে আকাশের দু’টি চন্দ্রের ন্যায়। এ দু’টি সূরার ফাযীলাত এজন্য বেশি যে, এতে শার‘ঈতের আহকামের নূর এবং আল্লাহ তা‘আলার আসমায়ে হুসনার উল্লেখ বেশি রয়েছে। কিয়ামাতের দিন এ সূরা দু’টি তার তিলাওয়াতকারীর মাথার উপর মেঘের ন্যায় অথবা আবরের ন্যায় অথবা পাখির পাখার ন্যায় ছায়া বিস্তার করে থাকবে।
এ দু’টি সূরা বান্দার পক্ষে আল্লাহর সামনে জেরা করবে, অর্থাৎ- সুপারিশ করবে এবং তাকে আগুন থেকে বাধা প্রদান করবে। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, আল্লাহর সামনে এ সূরা দু’টির জেরা করার অর্থ হলো তিলাওয়াতকারীর পক্ষে হুজ্জত কায়িম করা।
এ দু’টি সূরাকে পড়ার জন্য বিশেষভাবে তাকীদ করা হয়েছে, কারণ এতে রয়েছে অপরিমিত বারাকাত, পক্ষান্তরে তা বর্জনে রয়েছে অপরিমিত ক্ষতি এবং লোকসান, যা হবে কিয়ামাতের দিন ভীষণ আফসোসের কারণ। নির্বোধ অলস ব্যক্তিরাই কেবল এর তিলাওয়াত বর্জন করে থাকে।
২১২১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১২১
وَعَنِ النَّوَّاسِ بْنِ سَمْعَانَ قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِىَّ ﷺ يَقُولُ: «يُؤْتٰى بِالْقُرْاٰنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَهْلِهِ الَّذِينَ كَانُوا يَعْمَلُونَ بِه تَقْدُمُه سُورَةُ الْبَقَرَةِ وَاٰلُ عِمْرَانَ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ أَوْ ظُلَّتَانِ سَوْدَاوَانِ بَيْنَهُمَا شَرْقٌ أَوْ كَأَنَّهُمَا فِرْقَانِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ تُحَاجَّانِ عَنْ صَاحِبِهِمَا». رَوَاهُ مُسْلِمٌ
নাওয়াস ইবনু সাম্‘আন (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, কুরআন ও কুরআনপাঠকদের যারা কুরআন অনুযায়ী ‘আমাল করত (তাদের) কিয়ামাতের দিন উপস্থিত করা হবে। তাদের সামনে দু’টি মেঘখণ্ড অথবা দু’টি কালো ছায়ারূপে থাকবে সূরা আল বাকারাহ্ ও সূরা আ-লি ‘ইমরান। এদের মাঝখানে থাকবে দীপ্তি। অথবা থাকবে প্রসারিত- পালক বিশিষ্ট পাখির দু’টি ঝাঁক। তারা আল্লাহর নিকট কুরআন পাঠকের পক্ষে সুপারিশ করবে। (মুসলিম)[১]
২১২২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১২২
وَعَنْ أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «يَا أَبَا الْمُنْذِرِ أَتَدْرِىْ أَيُّ اٰيَةٍ مِنْ كِتَابِ اللّٰهِ مَعَكَ أَعْظَمُ؟». قَالَ: قُلْتُ اللّٰهُ وَرَسُولُه أَعْلَمُ قَالَ: «يَا أَبَا الْمُنْذِرِ أَتَدْرِىْ أَىُّ اٰيَةٍ مِنْ كِتَابِ اللّٰهِ مَعَكَ أَعْظَمُ؟». قَالَ: قُلْتُ ﴿اَللهُ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّوْمُ﴾. قَالَ فَضَرَبَ فِىْ صَدْرِىْ وَقَالَ: لِيَهْنِكَ الْعِلْمُ يَا أَبَا الْمُنْذِرِ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে আবূল মুনযির! তুমি কি বলতে পারো তোমার জানা আল্লাহর কিতাবের কোন্ আয়াতটি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলই ভাল জানেন। (এরপর) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবার বললেন, হে আবূল মুনযির! তুমি বলতে পারো কি তোমার জানা আল্লাহর কিতাবের কোন্ আয়াতটি শ্রেষ্ঠতর? এবার আমি বললাম, ‘‘আল্ল-হু লা- ইলা-হা ইল্লা- হুওয়াল হাইয়্যুল কইয়ূম।’’ উবাই বলেন, এবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার বুকে হাত মেরে বললেন, হে আবূল মুনযির! জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তোমার জন্য মুবারক হোক। (মুসলিম)[১]
উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর আল কুরআনের সবগুলো আয়াত-ই মুখস্থ ছিল, অর্থাৎ- তিনি পূর্ণ কুরআনের হাফেয ছিলেন। সুতরাং প্রশ্ন এবং উত্তরের অর্থ হলো আয়াতুল কুরসী সমগ্র কুরআনের শ্রেষ্ঠ আয়াত। ইসহাক ইবনু রহ্ওয়াই (রহঃ)-সহ কতিপয় মুহাক্কিক ‘আলিম বলেন, আয়াতুল কুরসী যেহেতু শ্রেষ্ঠ আয়াত; সুতরাং তার তিলাওয়াতকারীর সাওয়াব ও আজুরাও হবে সবচেয়ে বেশি এবং শ্রেষ্ঠ।
২১২৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১২৩
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: وَكَّلَنِىْ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ بِحِفْظِ زَكَاةِ رَمَضَانَ فَأَتَانِىْ اٰتٍ فَجَعَلَ يَحْثُو من الطَّعَامِ فَأَخَذْتُه وَقُلْتُ لَأَرْفَعَنَّكَ إِلٰى رَسُولِ اللّٰهِ ﷺ قَالَ إِنِّىْ مُحْتَاجٌ وَعَلَىَّ عِيَالٌ وَلِىْ حَاجَةٌ شَدِيدَةٌ قَالَ فَخَلَّيْتُ عَنْهُ فَأَصْبَحْتُ فَقَالَ النَّبِىُّ ﷺ: «يَا أَبَا هُرَيْرَةَ مَا فَعَلَ أَسِيْرُكَ الْبَارِحَةَ». قَالَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ شَكَا حَاجَةً شَدِيدَةً وَعِيَالًا فَرَحِمْتُه فَخَلَّيْتُ سَبِيلَه قَالَ: «أَمَا إِنَّه قَدْ كَذَبَكَ وَسَيَعُودُ». فَعَرَفْتُ أَنَّه سَيَعُودُ لِقَوْلِ رَسُوْلِ اللّٰهِ ﷺ: «أَنَّه سَيَعُوْدُ». فَرَصَدْتُه فَجَاءَ يَحْثُو مِنَ الطَّعَامِ فَأَخَذْتُه فَقُلْتُ: لَأَرْفَعَنَّكَ إِلٰى رَسُولِ اللّٰهِ ﷺ قَالَ دَعْنِىْ فَإِنِّىْ مُحْتَاجٌ وَعَلَىَّ عِيَالٌ لَا أَعُودُ فَرَحِمْتُه فَخَلَّيْتُ سَبِيلَه فَأَصْبَحْتُ فَقَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «يَا أَبَا هُرَيْرَةَ مَا فَعَلَ أَسِيرُكَ؟» قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ شَكَا حَاجَةً شَدِيدَةً وَعِيَالًا فَرَحِمْتُه فَخَلَّيْتُ سَبِيلَه قَالَ: «أَمَا إِنَّه قَدْ كَذَبَكَ وَسَيَعُودُ». فَرَصَدْتُّه فَجَاءَ يَحْثُوْ مِنَ الطَّعَامِ فَأَخَذْتُه فَقُلْتُ لَأَرْفَعَنَّكَ إِلٰى رَسُولُ اللهِ وَهٰذَا اٰخِرُ ثَلَاثِ مَرَّاتٍ إِنَّكَ تَزْعُمُ لَا تَعُودُ ثُمَّ تَعُودُ قَالَ دَعْنِىْ أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ يَنْفَعُكَ اللهُ بِهَا : إِذَا أَوَيْتَ إِلٰى فِرَاشِكَ فَاقْرَأْ اٰيَةَ الْكُرْسِىِّ ﴿اَللهُ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ﴾. حَتّٰى تَخْتِمَ الْاٰيَةَ فَإِنَّكَ لَنْ يَزَالَ عَلَيْكَ مِنَ اللهِ حَافِظٌ وَلَا يَقْرُبُكَ شَيْطَانٌ حَتّٰى تُصْبِحَ فَخَلَّيْتُ سَبِيلَه فَأَصْبَحْتُ فَقَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَا فَعَلَ أَسِيرُكَ؟» قُلْتُ: زَعَمَ أَنَّه يُعَلِّمُنِىْ كَلِمَاتٍ يَنْفَعنِىَ اللهُ بهَا. قَالَ اَمَا : «أمَا إِنَّه صَدَقَكَ وَهُوَ كَذُوْبٌ تَعْلَمُ مَنْ تُخَاطِبُ مُنْذُ ثَلَاث لَيَالٍ؟». قلت : لَا، قَالَ : «ذَاك شَيْطَانٌ». رَوَاهُ البُخَارِىُّ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, এক রাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ফিতরার মাল পাহারায় নিযুক্ত করলেন। এমন সময় আমার নিকট এক ব্যক্তি এসেই অঞ্জলি ভরে খাদ্যশস্য উঠাতে লাগল। আমি তাকে ধরে ফেললাম ও বললাম, আমি তোমাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট নিয়ে যাব। সে বলল, আমি একজন অভাবী লোক। আমার অনেক পোষ্য। আমি নিদারুণ কষ্টে আছি। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বলেন, আমি তখন তাকে ছেড়ে দিলাম। ভোরে আমি (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে) গেলাম। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবূ হুরায়রাহ্! তোমার হাতে গত রাতে বন্দী লোকটির কী অবস্থা? আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! বন্দীটি তার নিদারুণ অভাব ও বহু পোষ্যের অভিযোগ করল। তাই আমি তার ওপর দয়া করলাম। তাকে ছেড়ে দিলাম। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, শুনো! সে তোমার কাছে মিথ্যা বলেছে। সে আবার আসবে।
[আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বলেন] আমি রসূলের বলার কারণে বুঝলাম, অবশ্যই সে আবার আসবে। আমি তার অপেক্ষায় রইলাম। (ঠিকই) সে আবার এলো। দু’ হাতের কোষ ভরে খাদ্যশস্য উঠাতে লাগল এবং আমি তাকে ধরে ফেললাম। বললাম, আমি তোমাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে যাবো। সে বলল, তুমি আমাকে এবারও ছেড়ে দাও। আমি বড্ড অভাবী মানুষ। আমার পোষ্যও অনেক। আমি আর আসব না। এবারও আমি তার ওপর দয়া করলাম। ছেড়ে দিলাম। ভোরে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, আবূ হুরায়রাহ্! তোমরা বন্দীর খবর কী? আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! সে খুবই অভাবী। বহু পোষ্যের অভিযোগ করল। তাই আমি তার প্রতি দয়াপ্রদর্শন করলাম। তাকে ছেড়ে দিলাম। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, শুনো তোমার কাছে সে মিথ্যা বলেছে। আবারও যে আসবে।
(বর্ণনাকারী আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বলেন,) আমি বুঝলাম, সে আবারও আসবে। তাই আমি তার অপেক্ষায় থেকে তাকে ধরে ফেললাম। বললাম, তোমাকে আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট নিয়ে যাব। এটা তিনবারের শেষবার। তুমি ওয়া‘দা করেছিলে আর আসবে না। এরপরও তুমি এসেছ। সে বলল, এবারও যদি আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে এমন কয়টি বাক্য শিখাব, যে বাক্যের দ্বারা আল্লাহ তোমার উপকার করবেন। তুমি শোবার জন্য বিছানায় গেলে আয়াতুল কুরসী পড়বে, ‘‘আল্ল-হু লা- ইলা-হা ইল্লা- হুওয়াল হাইয়্যুল কইয়্যূম’’ আয়াতের শেষ পর্যন্ত। তাহলে আল্লাহর তরফ থেকে সব সময় তোমার জন্য একজন রক্ষী থাকবে, ভোর হওয়া পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান ঘেঁষতে পারবে না। এবারও তাকে আমি ছেড়ে দিলাম।
ভোরে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তোমার বন্দীর কী হলো? আমি বললাম (ইয়া রসূলাল্লাহ!), সে বলল, সে আমাকে এমন কয়টি বাক্য শিখাবে, যার দ্বারা আল্লাহ আমার উপকার করবেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ শুনো! এবার সে তোমার কাছে সত্য কথা বলেছে অথচ সে খুবই মিথ্যুক। তুমি কি জানো, তুমি এ তিন রাত কার সাথে কথা বলেছ? আমি বললাম, জি-না। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ ছিল একটা শয়তান। (বুখারী)[১]
এ সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন হিফাযাতকারী নিযুক্ত হন, শয়তান তার নিকটেও আসতে পারে না। সহীহুল বুখারীতে উল্লেখ আছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, গতরাতে শয়তান আমার ওপর চড়াও হয়েছিল, আমি তাকে ধরে ফেলেছিলাম তাকে এই খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার ভাই সুলায়মান (আঃ)-এর দু‘আর কথা মনে করে তা আর করিনি। তিনি আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছিলেন, হে আল্লাহ! আমাকে এমন এক রাজত্ব দাও আমার পরে কারো পক্ষে যেন তা করা সম্ভব না হয়।
আল্লাহ আরো বলেন, আমি বাতাসকে তার অনুগত করে দিয়েছিলাম। এখন প্রশ্ন হলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এবং আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) এর শয়তান ধরা কিভাবে সম্ভব হলো? এর উত্তর এই যে, সুলায়মান (আঃ) শয়তানের আসলরূপে ধরতেন এবং দেখতেন, আর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) শয়তান ধরেছিলেন কিন্তু সেটা ছিল মানুষের আকৃতিতে, তার নিজস্ব আকৃতিতে নয়। সুতরাং সুলায়মান (আঃ)-এর দু‘আ ভঙ্গ হয়নি। এ হাদীস থেকে অনেক বিষয় শিক্ষা লাভ করা যায়। যেমনঃ
১. শয়তান মু’মিনের উপকারী বিষয় জানে তবে হিকমাতের বিষয় হলো এই যে, ফাসিক ফাজির তা শিক্ষা করে, তা থেকে উপকার গ্রহণ করতে পারে না। আর মু’মিন তার নিকট থেকে শিখে উপকার গ্রহণ করতে পারেন।
২. কাফিরের কতিপয় কথা বিশ্বাসযোগ্য। তবে এ বিশ্বাসযোগ্য কথা বলেই সে মু’মিন হয়ে যায় না। আর শয়তানের অভ্যাস হলো মিথ্যা বলা। মিথ্যাবাদী কখনো সত্য কথা বলে থাকে।
৩. শয়তান (জিন্) অন্যরূপ ধরলে তাকে দেখা সম্ভব।
৪. কোন সম্পদ রক্ষার জন্য নিযুক্ত রক্ষককে উকীল বলা যাবে।
৫. জিন্ মানুষের খাদ্য খায়।
৬. জিনেরাও চুরি করে এবং ধোঁকা দেয়।
তাছাড়ও এ হাদীসে আয়াতুল কুরসীর ফাযীলাত বর্ণিত হয়েছে, সদাকাতুল ফিতর ঈদের আগে উত্তোলনের বৈধতা প্রমাণিত হয়েছে এবং তা রক্ষণের জন্য একজন উকীল নিযুক্ত করার বৈধতাও স্বীকৃত হয়েছে।
২১২৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১২৪
وَعَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: بَيْنَمَا جِبْرِيلُ قَاعِدٌ عِنْدَ النَّبِىِّ ﷺ سَمِعَ نَقِيضًا مِنْ فَوْقِه فَرَفَعَ رَأْسَه فَقَالَ: «هٰذَا بَابٌ مِنَ السَّمَاءِ فُتِحَ الْيَوْمَ لَمْ يُفْتَحْ قَطُّ إِلَّا الْيَوْمَ فَنَزَلَ مِنْهُ مَلَكٌ فَقَالَ هٰذَا مَلَكٌ نَزَلَ إِلَى الْأَرْضِ لَمْ يَنْزِلْ قَطُّ إِلَّا الْيَوْمَ فَسَلَّمَ وَقَالَ أَبْشِرْ بِنُورَيْنِ أُوتِيتَهُمَا لَمْ يُؤْتَهُمَا نَبِىٌّ قَبْلَكَ فَاتِحَةُ الْكِتَابِ وَخَوَاتِيمُ سُورَةِ الْبَقَرَةِ لَنْ تَقْرَأَ بِحَرْفٍ مِنْهُمَا إِلَّا أَعْطَيْتُه». رَوَاهُ مُسْلِمٌ
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একদিন জিবরীল আমীন (আঃ) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে বসে ছিলেন। এ সময় উপরের দিক হতে দরজা খোলার শব্দ [জিবরীল (আঃ)] শুনলেন। তিনি উপরের দিকে মাথা উঠালেন এবং বললেন, আসমানের এ দরজাটি আজ খোলা হলো। এর আগে আর কখনো তা খোলা হয়নি। (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ) এ দরজা দিয়ে একজন মালাক (ফেরেশতা) নামলেন। তখন জিবরীল (আঃ) বললেন, যে মালাক (আজ) জমিনে নামলেন, আজকে ছাড়া আর কখনো তিনি জমিনে নামেননি। (রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,) তিনি সালাম করলেন। তারপর আমাকে বললেন, আপনি দু’টি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। এটা আপনার আগে আর কোন নাবীকে দেয়া হয়নি। (তাহলো) সূরা আল ফাতিহাহ্ ও সূরা আল বাকারাহ্’র শেষাংশ। আপনি এ দু’টি সূরার যে কোন বাক্যই পাঠ করুন না কেন নিশ্চয়ই আপনাকে তা দেয়া হবে। (মুসলিম)[১]
সূরা ফাতিহাহ্ এবং সূরা বাকারাহ্’র শেষ অংশকে দু’টি নূর বলে নামকরণ করা হয়েছে এজন্য যে, কিয়ামাতের দিন এ দু’টি তার পাঠকের জন্য নূর হয়ে তার সামনে দিয়ে চলতে থাকবে। অথবা এর অর্থ এ দু’টি সূরা ও আয়াত দু’টি তাকে সিরাতে মুস্তাক্বীমের পথ দেখিয়ে থাকে এবং হিদায়াত দান করে থাকে।
২১২৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১২৫
وَعَنْ أَبِىْ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «الْاٰيَتَانِ مِنْ اٰخَرِ سُوْرَةِ الْبَقَرَةِ مَنْ قَرَأَ بِهِمَا فِىْ لَيْلَةٍ كَفَتَاهُ». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি রাতে সূরা আল বাকারার শেষ দু’টি আয়াত, অর্থাৎ- ‘আ-মানার রসূলু’ হতে শেষ পর্যন্ত পড়ে, সেটাই তার জন্য যথেষ্ট হবে। (বুখারী, মুসলিম)[১]
২১২৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১২৬
وَعَنْ أَبِىْ الدَّرْدَاءِ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: مَنْ حَفِظَ عَشَرَ اٰيَاتٍ مِنْ أَوَّلِ سُوْرَةِ الْكَهْفِ عَصَمَ مِنَ فِتْنَةِ الدَّجَّالِ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
আবূ দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সূরা আল কাহাফ-এর প্রথম দশটি আয়াত মুখস্থ করবে তাকে দাজ্জালের অনিষ্ট হতে নিরাপদ রাখা হবে। (মুসলিম)[১]
‘আল্লামা ত্বীবী বলেন, (এ সূরায় বর্ণিত বিস্ময়কর ঘটনা) যুবকেরা যেমন স্বেচ্ছাচার যালিম বাদশাহের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন তেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা (ঐ দশ আয়াত) পাঠকারীকে যালিমের হাত থেকে অথবা সৃষ্টির অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করবেন।
সহীহ মুসলিম ও সুনান আবী দাঊদ-এর বর্ণনায় সূরা কাহাফ-এর প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তিরমিযীর বর্ণনায় তিন আয়াত পড়ার কথা বলা হয়েছে। দুই রকম বর্ণনার মাঝে সমাধান এভাবে দেয়া যায় যে, দশ আয়াত সংক্রান্ত হাদীসটি পরে বর্ণিত হাদীস। সুতরাং এটার উপর ‘আমাল করতে হবে। যে দশের ‘আমাল করবে সে তিনের ফাযীলাত অবশ্যই পাবে। অথবা তিনের হাদীস-ই পরের হাদীস, তিন আয়াত পাঠ করে যদি নিরাপদ হয়ে যায় তাহলে দশ আয়াত পাঠের কোন প্রয়োজন নেই। আবার কেউ বলেছেন, দশ আয়াতের হাদীস হলো মুখস্থ করার ক্ষেত্রে আর তিন আয়াতের হাদীস হলো দেখে দেখে পাঠের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে।
ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, দশ আয়াত আর তিন আয়াতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। বেশি সংখ্যার উপর ‘আমাল করাই আবশ্যক। সুতরাং প্রথমের দশ আয়াত পাঠ করবে। আরেকটি বিষয় জ্ঞাতব্য যে, কোন হাদীসে সূরা আল কাহাফ-এর শেষ দশ আয়াতের কথা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমাদ, মুসলিম, আবূ দাঊদ, নাসায়ী প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
উভয় হাদীসের সমন্বয়ে ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, তিলাওয়াতকারী সূরার শুরু থেকে দশ আয়াত এবং শেষ থেকে দশ আয়াত পাঠ করবে। আর যে ব্যক্তি চায় সকল হাদীসের উপর তার ‘আমাল হোক সে যেন পূর্ণ সূরাটাই তিলাওয়াত করে নেয়।
২১২৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১২৭
وَعَنْ أَبِىْ الدَّرْدَاءِ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «أَيَعْجَزُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَقْرَأَ فِىْ لَيْلَةٍ ثُلُثَ الْقُرْاٰنِ؟» قَالُوا: وَكَيْفَ يَقْرَأُ ثُلُثَ الْقُرْاٰنِ؟ قَالَ: ﴿قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ﴾ يَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْاٰنِ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
আবূ দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ কি প্রতি রাতে এক-তৃতীয়াংশ কুরআন তিলাওয়াতে সক্ষম? সাহাবীগণ বললেন, প্রতি রাতে কি করে এক-তৃতীয়াংশ কুরআন পড়া যাবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সূরা ‘কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ’ কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান। (মুসলিম)[১]
১. আহকাম ২. ঘটনা বা ইতিহাস ৩. তাওহীদ বা একত্ববাদ। সূরা ইখলাস তৃতীয়টি প্রকাশে শ্রেষ্ঠ সূরা। সুতরাং এটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। এ কথার সহায়ক সহীহ মুসলিমের বর্ণনা, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা পূর্ণ কুরআনকে তিন অংশে বিভক্ত করেছেন, কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ পুরো কুরআনের তিন ভাগের একভাগ।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, এ সূরার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহের এমন দু’টি নাম ব্যবহার হয়েছে যার মধ্যে তার সকল গুণাবলীর পূর্ণতা নিহীত রয়েছে। অন্য কোন সূরার মধ্যে তা খুঁজে পাওয়া যায় না। এ দু’টি সিফাতে কামাল বা পূর্ণগুণবাচক নাম হলো আল আহাদ এবং আস্ সামাদ।
আল্লাহ তা‘আলার এ দু’টি গুণবাচক নাম তার পবিত্র সত্তার একত্বের অর্থ প্রকাশক এবং তার চূড়ান্ত বিশেষণ। এ বর্ণনা এ অনুভূতি জাগ্রত করে যে, এই একত্বের গুণ কেবল তার জন্যই খাস এতে অন্য কারো অংশীদারিত্বের সুযোগ নেই।
আস্ সামাদ নামটির এ অনুভূতি জাগ্রত করে যে, অমুখাপেক্ষিতার পূর্ণগুণ একমাত্র আল্লাহর জন্যই খাস। এ গুণ পূর্ণরূপে কারো মধ্যেই নেই। সুতরাং এ গুণবাচক নাম অন্য কারো জন্য চলবে না। অতএব এ অদ্বিতীয় গুণ সম্বলিত নাম সমবিভ্যাহারে এ সূরাটি আল্লাহর পবিত্র স্বকীয় সত্তার পরিচয় জানার জন্য অন্য সকল সূরা তথা পূর্ণ কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান।
একদল বলেছেন, সূরা ইখলাসকে আল কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সাথে দৃষ্টান্ত হলো সাওয়াবের দিক থেকে, অর্থাৎ- এ সূরা তিলাওয়াতকারী পূর্ণ কুরআন পাঠের এক তৃতীয়াংশের মতো সাওয়াব পাবে। অবশ্য ইবনু ‘উকায়ল এ কথাটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন, ইবনু রাহওয়াই তা সমর্থন করেছেন।
কেউ কেউ বলেছেন, কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ এর সাওয়াব দ্বিগুণ বা অধিক গুণে দেয়া হবে যা কুরআনের অন্যান্য সূরা ডাবল সাওয়াববিহীন আল কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। তবে এ কথার পক্ষে কোন দলীল নেই।
২১২৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১২৮
وَرَوَاهُ البُخَارِىُّ عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ
ইমাম বুখারী থেকে বর্ণিতঃ
হাদীসটি আবূ সা‘ঈদ হতে বর্ণনা করেছেন।[১]
২১২৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১২৯
وَعَنْ عَائِشَةَ: أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ بَعَثَ رَجُلًا عَلٰى سَرِيَّةٍ وَكَانَ يَقْرَأُ لأَصْحَابِه فِىْ صَلَاتِهِمْ فِيَخْتِمُ بِـ ﴿قُلْ هُوَ اللّٰهُ أَحَدٌ﴾. فَلَمَّا رَجَعُوا ذَكَرُوا ذٰلِكَ لِلنَّبِىِّ ﷺ فَقَالَ: «سَلُوهُ لِأَىِّ شَىْءٍ يَصْنَعُ ذٰلِكَ» فَسَأَلُوهُ فَقَالَ لِأَنَّهَا صِفَةُ الرَّحْمٰنِ وَأَنَا أَحَبُّ أَنْ أَقرَأَ هَا. فَقَالَ النَّبِىُّ ﷺ: «أَخْبِرُوهُ أَنَّ اللهَ يُحِبُّه». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
একবার নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে একটি সেনাদলের সেনাপতি করে পাঠালেন। সে তার সঙ্গীদের সলাত আদায় করাত এবং ‘কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ’ দিয়ে সলাত শেষ করত। তারা মাদীনায় ফেরার পর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ কথা উল্লেখ করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তাকে জিজ্ঞেস করো কি কারণে সে তা করে। সে বলল, এর কারণ এতে আল্লাহর গুণাবলীর উল্লেখ রয়েছে। আর আমি আল্লাহর গুণাবলী পড়তে ভালবাসি। তার উত্তর শুনে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে জানিয়ে দাও, আল্লাহ তা‘আলাও তাকে ভালবাসেন। (বুখারী, মুসলিম)[১]
তিনি সূরা আল ফাতিহার পর অন্য একটি সূরা অথবা কুরআনের অন্য কোন আয়াত তিলাওয়াত করে নিয়ে সর্বশেষ সূরা ইখলাস পাঠ করতেন। এর দ্বারা প্রমাণিত, এক রাক্‘আতের মধ্যে সূরা আল ফাতিহাহ্ ছাড়াও দু’টি সূরা পাঠ করা যায়।
এভাবে সলাত আদায় করার কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, এ সূরায় রহমানের গুণাবলী রয়েছে। ইবনুত্ তীন বলেন, এর অর্থ হলো এর মধ্যে আল্লাহর অনেক নাম এবং গুণাবলী রয়েছে। তার নামগুলো তার সিফাত থেকেই মুশতাক হয়েছে।
কেউ কেউ বলেছেন, লোকটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ বিষয়ে কিছু শুনে তার উপর ভিত্তি করেই হয়তো এ কথা বলেছেন।
২১৩০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৩০
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: إِنَّ رَجُلًا قَالَ: يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ إِنِّىْ أُحِبُّ هٰذِهِ السُّورَةَ: ﴿قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ﴾. قَالَ: إِنَّ حُبَّكَ إِيَّاهَا أَدْخَلَكَ الْجَنَّةَ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَرَوَى البُخَارِىُّ مَعْنَاهُ
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমি এ ‘কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ’ সূরাকে ভালবাসি। (এ কথা শুনে) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার এ সূরার প্রতি ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিযী; এই একই অর্থের একটি হাদীস ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন)[১]
২১৩১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৩১
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: أَلَمْ تَرَ اٰيَاتٍ أُنْزِلَتِ اللَّيْلَةَ لَمْ يُرَ مِثْلُهُنَّ قَطُّ ﴿قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ﴾. وَ ﴿قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ﴾. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
উকবাহ্ ইবনু ‘আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আজ রাতে এমন কিছু আশ্চর্যজনক আয়াত নাযিল হয়েছে আগে এ রকম কোন আয়াত (নাযিল) হতে দেখা যায়নি। (আর তা হলো) ‘‘কুল আ‘ঊযু বিরাব্বিল ফালাক’’ ও ‘‘কুল আ‘ঊযু বিরাবিবন্না-স’’। (মুসলিম)[১]
আশ্রয় প্রার্থনার অন্যান্য দু‘আ যা ইতিপূর্বে পড়তেন তা ছেড়ে দিলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যাদু করলে তিনি এ দু’টি সূরার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করেন।
এ হাদীস দ্বারা আরো প্রমাণিত যে, এ দু’টি কুরআনের সূরার উপর উম্মাতের ইজমা রয়েছে। ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) এ দু’টি সূরাকে কুরআনের সূরা হিসেবে না মানার যে কথাটি তা সঠিক নয় বরং মিথ্যা এবং বাতিল। বরং তার নিকট সহীহভাবে কুরআনের সূরা হওয়ার স্বীকৃতি রয়েছে।
২১৩২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৩২
وَعَنْ عَائِشَةَ: أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ كَانَ إِذَا أَوٰى إِلٰى فِرَاشِه كُلَّ لَيْلَةٍ جَمَعَ كَفَّيْهِ ثُمَّ نَفَثَ فِيهِمَا فَقَرَأَ فِيْهِمَا ﴿قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ﴾. وَ ﴿قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ﴾. وَ ﴿قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ﴾. ثُمَّ يَمْسَحُ بِهِمَا مَا اسْتَطَاعَ مِنْ جَسَدِه يَبْدَأُ بِهِمَا عَلٰى رَأْسِه وَوَجْهِه وَمَا أَقْبَلَ مِنْ جَسَدِه يَفْعَلُ ذٰلِكَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ‐ (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ). وَسَنَذْكُرُ حَدِيثَ ابْنِ مَسْعُودٍ: لَمَّا أُسْرِىَ بِرَسُولِ اللّٰهِ ﷺ فِىْ بَابِ الْمِعْرَاج إِن شَآءَ اللهُ تَعَالٰى
আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রাতে (ঘুমাবার জন্য) বিছানায় যাবার সময় দু’ হাতের তালু একত্র করতেন। তারপর এতে ‘কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ, কুল আ‘ঊযু বিরাব্বিল ফালাক ও কুল আ‘ঊযু বিরাব্বিন্না-স’ পড়ে ফুঁ দিতেন। এরপর এ দু’ হাত দিয়ে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর শরীরের যতটুকু সম্ভব হত মুছে নিতেন। শুরু করতেন মাথা, চেহারা এবং শরীরের সম্মুখ ভাগ হতে। এভাবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিনবার করতেন। (বুখারী, মুসলিম।)
ইবনু মাস্‘ঊদণ্ডএর হাদীস (لَمَّا أُسْرِىَ بِرَسُولِ اللّٰهِ ﷺ) ‘‘যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে [স্বশরীরে] রাতে সফর করানো হয়েছে’’ আমরা ‘মি‘রাজ’ অধ্যায়ে অচিরেই বর্ণনা করব [ইনশাআল্লাহ]।)[১]
২১৩৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৩৩
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ بْنِ عَوْفٍ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ: «ثَلَاثَةٌ تَحْتَ الْعَرْشِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْقُرْاٰنُ يُحَاجُّ الْعِبَادَ لَه ظَهْرٌ وَبَطْنٌ وَالْأَمَانَةُ وَالرَّحِمُ تُنَادِىْ: أَلَا مَنْ وَصَلَنِىْ وَصَلَهُ اللّٰهُ وَمَنْ قَطَعَنِىْ قَطَعَهُ اللّٰهُ». رَوَاهُ فِىْ شَرْحِ السُّنَّةِ
আবদুর রহমান ইবনু ‘আওফ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ইরশাদ করেছেনঃ তিনটি জিনিস কিয়ামাতের দিন আল্লাহর ‘আরশের নীচে থাকবে। (১) কুরআন, এ কুরআন বান্দাদের (পক্ষে বিপক্ষে) আর্জি পেশ করবে। এর যাহের ও বাতেন দু’দিক রয়েছে। (২) আমানাত ও (৩) আত্মীয়তার বন্ধন। (এ তিনটি জিনিসের প্রত্যেকে ফরিয়াদ করবে, হে আল্লাহ! যে আমাকে রক্ষা করেছে তুমি [আল্লাহ] তাকে রক্ষা করো। যে আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আল্লাহ তাকে ছিন্ন করো।) (ইমাম বাগাবী: শারহুস্ সুন্নাহ)[১]
যেমনভাবে অন্য হাদীসে এসেছে, القران حجة لك او عليك
অর্থাৎ- আল কুরআন হয় তোমার পক্ষে দলীল হবে আর না হয় তোমার বিপক্ষে। এই কুরআনের বাহির এবং ভিতর দু’টি দিক আছে। কেউ বলেন, এর অর্থ হলো শব্দ এবং অর্থ। কেউ বলেছেন, বাহির হলো এর তিলাওয়াত এবং ভিতর হলো তার সূক্ষ্ম চিন্তা ও গবেষণা। কেউ আবার বলেছেন, বাহির হলো প্রত্যেক বালিগ ব্যক্তিই এর বিধান মোতাবেক ‘আমালে বাধ্য এবং তার ওপর ঈমান আনতে বাধ্য। আর ভিতর হলো স্তর ভেদে মানুষ তার অর্থ অনুধাবন করে থাকে। কুরআন পাঠ করে কেউ স্বাভাবিক জ্ঞান অর্জন করে থাকে কেউ মধ্যম কেউবা আবার গভীর জ্ঞান হাসিল করে থাকে; এটাই হলো তার বাহির ও ভিতরের দৃষ্টান্ত।
দ্বিতীয়টি হলো আমানাত। আল্লাহর প্রত্যেক হক-ই হলো আমানাত। অথবা তা এমন একটি বিষয় যা পালন করা আবশ্যক।
আল্লাহ তা‘আলার কথায় যার ব্যাখ্যা এসেছে, إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ
‘‘আমি আমানাত পেশ করছি।’’ (সূরা আল আহযাব ৩৩ : ৭২)
নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর হক, অবশ্য পালনীয়।
তৃতীয়টি হলো রেহম বা বাচ্চাদান (জরায়ু) উদ্দেশ্য হলো আত্মীয়তার সম্পর্ক। রেহম বা আত্মীয়তার সম্পর্ক কিয়ামাতের দিন চিৎকার করে বলবে, অথবা আমানাত এবং রেহম উভয়েই চিৎকার করে বলবে, অথবা কুরআন আমানাত এবং রেহম সকলেই চিৎকার করে বলবে। কিন্তু কুরআন ও আমানাতের কথা স্বতন্ত্রভাবে বলা হয়েছে। সুতরাং এই রেহম আল্লাহ তা‘আলার নিকট চিৎকার করে বলবে, এটাই শক্তিশালী মত। সে বলবে যে আমার সম্পর্ক রক্ষা করেছে আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করুন, আর যে আমার সাথে (আত্মীয়তার) সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তার সাথে (রহমাতের) সম্পর্ক ছিন্ন করুন।
আর যদি ঐ চিৎকার ও ঘোষণা কুরআন, আমানাত এবং রেহম তিনটি জিনিসের-ই হয়ে থাকে তাও হতে পারে, প্রত্যেকের হক আদায়ের দায়িত্ব রয়েছে, যে তা আদায় করবে সে তা আদায়কারীর দু‘আ লাভ করবে, যে আদায় করবে না সে বদ্দু‘আ পাবে।
এখানে আল কুরআনকে আগে আনা হয়েছে এজন্য যে, কুরআন হলো আল্লাহর হক আর আল্লাহর হক সবচেয়ে বড় এবং অগ্রণীয়।
২১৩৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৩৪
وَعَنْ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْاٰنِ: اِقْرَأْ وَارَتْقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِى الدُّنْيَا فَإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ اٰخِرِ اٰيَةٍ تَقْرَؤُهَا». رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِىُّ أَبُوْ دَاوُدَ وَالنَّسَائِىُّ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআন পাঠকারীকে কিয়ামাতের দিন বলা হবে, পাঠ করতে থাকো আর উপরে উঠতে থাকো। (অক্ষরে অক্ষরে ও শব্দে শব্দে) সুস্পষ্টভাবে পাঠ করতে থাকো, যেভাবে দুনিয়াতে স্পষ্টভাবে পাঠ করতে। কারণ তোমার স্থান (মর্যাদা) হবে যা তুমি পাঠ করবে শেষ আয়াত পর্যন্ত (আয়াত পাঠের তুলনাগত দিক থেকে)। (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, নাসায়ী)[১]
ইবনু মিরদুওয়াই, বায়হাক্বী প্রমুখ ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই জান্নাতের স্তর কুরআনের আয়াতের সংখ্যা পরিমাণ।
২১৩৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৩৫
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «إِنَّ الَّذِىْ لَيْسَ فِىْ جَوْفِه شَىْءٌ مِنَ الْقُرْاٰنِ كَالْبَيْتِ الْخَرِبِ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَالدَّارِمِىُّ. وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ: هٰذَا حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে পেটে কুরআনের কিছু নেই তা শূন্য (ধ্বংসপ্রাপ্ত) ঘরের মতো। (তিরমিযী ও দারিমী; ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি সহীহ)[১]
অন্তরে যখন কুরআন থাকবে তা হবে ঐ অন্তরের কাঠামো গঠক এবং কুরআনের পরিমাণ অনুযায়ী সৌন্দর্য বর্ধনকারী। কুরআন যত বেশি থাকবে অন্তর তত সুশোভিত হবে। একজন মুসলিমের জন্য যা দরকার ন্যূনতম পরিমাণের এতটুকু কুরআন যদি তার অন্তরে না থাকে তাহলে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, মহব্বত, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি শূন্য হয়ে সে যেন একটি বিধ্বস্ত ইমারতের ন্যায় হয়ে যায়।
২১৩৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৩৬
وَعَنْ أَبِىْ سَعِيدٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «يَقُولُ الرَّبُّ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى: مَنْ شَغَلَهُ الْقُرْاٰنُ عَنْ ذِكْرِىْ وَمَسْأَلَتِىْ أَعْطَيْتُه أَفْضَلَ مَا أُعْطِى السَّائِلِينَ. وَفَضْلُ كَلَامِ اللّٰهِ عَلٰى سَائِرِ الْكَلَامِ كَفَضْلِ اللّٰهِ عَلٰى خَلْقِه». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَالدَّارِمِىُّ وَالْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيمَانِ وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ هٰذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ
আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যাকে আমার জিকির ও আমার কাছে কিছু চাওয়া হতে কুরআন বিরত রেখেছে, আমি তাকে প্রার্থনাকারীদের চেয়ে বেশি দান করব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, কেননা আল্লাহর কালামের শ্রেষ্ঠত্ব অন্য সব কালামের উপর; যেমন আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর সৃষ্টির উপর। (তিরমিযী, দারিমী ও বায়হাক্বী- শু‘আবূল ঈমানে। ইমাম তিরমিযী বলেছেন, হাদীসটি হাসান ও গরীব।)[১]
২১৩৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৩৭
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللّٰهِ فَلَه بِه حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لَا أَقُولُ: اَلٓمٓ حَرْفٌ. أَلْفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَالدَّارِمِىُّ وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ هٰذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيْبٌ إِسْنَادًا
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের কোন একটি অক্ষরও পাঠ করবে, সে নেকী পাবে। আর নেকী হচ্ছে ‘আমালের দশ গুণ। আমি বলছি না যে, الٓمٓ)) ‘আলিফ লাম মীম’ একটি অক্ষর। বরং ‘আলিফ’ একটি অক্ষর, ‘লাম’ একটি অক্ষর ও ‘মীম’ একটি অক্ষর। (তাই আলিফ, লাম ও মীম বললেই ত্রিশটি নেকী পাবে)। (তিরমিযী, দারিমী। আর ইমাম তিরমিযী বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। কিন্তু সানাদের দিক দিয়ে গরীব।)[১]
২১৩৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৩৮
وَعَنِ الْحَارِثِ الْأَعْوَرِ قَالَ: مَرَرْتُ فِى الْمَسْجِدِ فَإِذَا النَّاسُ يَخُوضُونَ فِى الْأَحَادِيثِ فَدَخَلْتُ عَلٰى عَلِىِّ فَأَخْبَرْتُه قَالَ: أَوَقَدْ فَعَلُوهَا؟ قُلْتُ نَعَمْ قَالَ: أما إِنِّىْ قَدْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ يَقُول: «أَلا إِنَّهَا سَتَكُوْنُ فِتْنَةٌ». قُلتُ : مَا الْمَخْرَجُ مِنْهَا يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ قَالَ: «كِتَابُ اللهِ فِيْهِ نَبَأُ مَا كَانَ قَبْلَكُمْ وَخَبْرُ مَا بَعْدَكُمْ وَحُكْمُ مَا بَيْنكُمْ وَهُوَ الْفَصْلُ لَيْسَ بِالْهَزْلِ مَنْ تَرَكَه مِنْ جَبَّارٍ قَصَمَهُ اللّٰهُ وَمَنِ ابْتَغَى الْهُدٰى فِىْ غَيْرِه أَضَلَّهُ اللّٰهُ وَهُوَ حَبْلُ اللّٰهِ الْمَتِينُ وَهُوَ الذِّكْرُ الْحَكِيمُ وَهُوَ الصِّرَاطُ الْمُسْتَقِيمُ هُوَ الَّذِىْ لَا تَزِيغُ بِهِ الْأَهْوَاءُ وَلَا تَلْتَبِسُ بِهِ الْأَلْسِنَةُ وَلَا يَشْبَعُ مِنْهُ الْعُلَمَاءُ وَلَا يَخْلِقُ عَنْ كَثْرَةِ الرَّدِّ وَلَا يَنْقَضِىْ عَجَائِبُه هُوَ الَّذِىْ لَمْ تَنْتَهِ الْجِنُّ إِذْ سَمِعَتْهُ حَتّٰى قَالُوا (إِنَّا سَمِعْنَا قُرْاٰنًا عَجَبًا يَهْدِىْ إِلَى الرُّشْدِ فَاٰمَنا بِه). مَنْ قَالَ بِه صَدَقَ وَمَنْ عَمِلَ بِه أُجِرَ وَمَنْ حَكَمَ بِه عَدَلَ وَمَنْ دَعَا إِلَيْهِ هُدِىَ إِلٰى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَالدَّارِمِىُّ وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ: هٰذَا حَدِيثٌ إِسْنَادُه مَجْهُولٌ وَفِى الْحَارِثِ مَقَالٌ
হারিস আ‘ওয়ার (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
বলেন, আমি (একদিন কূফার) মাসজিদে বসা লোকজনের কাছে গেলাম। দেখলাম, লোকেরা আজে-বাজে কথায় ব্যস্ত। এরপর আমি ‘আলী (রাঃ) এর কাছে গিয়ে এ খবর বললাম। তিনি বললেন, তারা এমন করছে? আমি জবাব দিলাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, (তবে) শুনো, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, সাবধান! শীঘ্রই পৃথিবীতে কলহ-ফাসাদ আরম্ভ হবে। আমি [‘আলী] বললাম, হে আল্লাহর রসূল! এ থেকে বাঁচার উপায় কী? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আল্লাহর কিতাব, এতে তোমাদের আগের ও পরের খবর রয়েছে। তোমাদের ভিতরে বিতর্কের মীমাংসার পদ্ধতিও রয়েছে। সত্য মিথ্যার পার্থক্যও আছে। এটা কোন অর্থহীন কিতাব নয়। যে অহংকারী ব্যক্তি এ কুরআন ত্যাগ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণ করবেন। যে ব্যক্তি এর বাইরে হিদায়াত সন্ধান করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে পথভ্রষ্ট করবেন। এ কুরআন হলো আল্লাহর মজবুত রশি। জিকির ও সত্য সরল পথ।
কুরআন অবলম্বন করে কোন প্রবৃত্তি বিপথগামী হয় না। এর দ্বারা যবানের কষ্ট হয় না। এর দ্বারা প্রজ্ঞাবানগণ বিতৃষ্ণ হয় না। এ কুরআন বার বার পাঠ করায় পুরাতন হয় না। এ কুরআনের বিস্ময়কর তথ্য অশেষ। কুরআন শুনে স্থির থাকতে পারেনি জিনেরা। এমনকি তারা এ কুরআন শুনে বলে উঠেছিল, ‘‘শুনেছি আমরা এমন এক বিস্ময়কর কুরআন। যা সন্ধান দেয় সত্য পথের। অতএব ঈমান এনেছি আমরা এর উপর।’’ যে ব্যক্তি কুরআনের কথা সত্য বলে, যে এর উপর ‘আমাল করে, সে পুরস্কার পাবে। যে এর দ্বারা বিচার-ফায়সালা করে, ন্যায়বিচার করে, যে (মানুষকে) এর দিকে ডাকে, সে সত্য সরল পথের দিকেই ডাকে। (তাই এরূপ কুরআন ছেড়ে তারা কেন অন্য আলোচনায় বিভোর হচ্ছে?)। (তিরমিযী ও দারিমী। কিন্তু ইমাম তিরমিযী বলেছেন, এ হাদীসের সানাদ মাজহূল [অপরিচিত]। আর হারিস আল আ‘ওয়ার-এর ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে।)[১]
ইসলাম ও শারী‘আতের সকল ভিত্তি মূল হলো এই কুরআন। সত্যমিথ্যার প্রভেদকারী, এতে কোন মিথ্যা অহেতুক অনর্থক কথা নেই। অহংকারবশে যদি কেউ এ কুরআনের উপর ঈমান ও ‘আমাল ত্যাগ করে তাহলে আল্লাহ তার গর্দান মটকিয়ে তাকে ধ্বংস করে দিবেন।
আল্লাহর মারিফাত অর্জনে আল কুরআন হলো অতীব মজবুত রশ্মি, প্রজ্ঞাপূর্ণ নাসীহাত এবং সরল সঠিক পথ। এ পথ অবলম্বন করলে কেউ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। অনারবী ভাষা-ভাষীর জন্যও এর পাঠ-পঠন কষ্টকর নয়। এর তথ্যসমূহ অতীব বিস্ময়কর। জিনেরা এ কুরআনের তিলাওয়াত শুনে বিস্ময়াভিভূত হয়ে ঈমান আনয়ন করেছে।
২১৩৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৩৯
وَعَن معَاذ الْجُهَنِىِّ: أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ قَالَ: «مَنْ قَرَأَ الْقُرْاٰنَ وَعَمِلَ بِمَا فِيهِ أُلْبِسَ وَالِدَاهُ تَاجًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ضَوْءُه أَحْسَنُ مِنْ ضَوْءِ الشَّمْسِ فِىْ بُيُوتِ الدُّنْيَا لَوْ كَانَتْ فِيكُمْ فَمَا ظَنُّكُمْ بِالَّذِىْ عَمِلَ بِهٰذَا؟». رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُوْ دَاوُدَ
মু‘আয আল জুহানী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং এর মধ্যে তাঁর হুকুম-আহকামের উপর ‘আমাল করে, তার মাতাপিতাকে কিয়ামাতের দিন একটি মুকুট পরানো হবে। এ মুকুটের কিরণ দুনিয়ার সূর্যের কিরণ হতেও উজ্জ্বল হবে, যদি এ সূর্য তোমাদের মধ্যে থাকত (তবে উপলব্ধি করতে পারতে)। যে ব্যক্তি এ কুরআনের উপর ‘আমাল করে তার ব্যাপারে এখন তোমাদের কী ধারণা? (আহমদ, আবূ দাঊদ)[১]
এই উজ্জ্বলতা দৃষ্টিবিষাদী এবং তাপ বিচ্ছুরিত হবে না। বরং এ তাজ হবে অতি মূল্যবান অলংকারখচিত এক দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য শোভিত আলোকপিন্ডর ন্যায়।
তাহলে ঐ কুরআনের বিধান মোতাবেক ‘আমালকারী সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি? এখানে এ প্রশ্নবোধক ما ‘মা’ শব্দটি تحير الظان বা ধারণাকে হতবুদ্ধি করে ফেলানো অর্থে ব্যবহার হয়েছে। এর অর্থ তুমি ধারণাও করতে পারবে না যে, তাকে কি পুরস্কার দেয়া হবে। কোন চোখ তা দেখেনি, কোন কান তা শুনেনি এবং কোন অন্তর তা অনুধাবন করেনি। সুতরাং তার পুরস্কার দেখে তুমি হতবুদ্ধি হয়ে যাবে।
২১৪০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৪০
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ يَقُولُ: «لَوْ جُعِلَ الْقُرْاٰنُ فِى اهَابٍ ثُمَّ أُلْقِىَ فِى النَّار مَا احْتَرَقَ». رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ
উকবাহ্ ইবনু ‘আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, কুরআন কারীমকে যদি চামড়ায় মুড়িয়ে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় তাহলে তা পুড়বে না। (দারিমী)[১]
কেউ কেউ বলেছেন, এটা রসূলের যুগের বিশেষ মু‘জিযা ঐ সময় কেউ মাসহাফকে চামড়ায় তুলে আগুনে দিলে তা জ্বলতো না।
কেউ বলেছেন এর অর্থ হলো যার অন্তরে কুরআনুল কারীম থাকবে আগুন তাকে জ্বালাবে না। আহমাদ ইবনু হাম্বল, আবূ ‘উবায়দ প্রমুখ মনীষী থেকে অনুরূপ হেকায়েত বর্ণিত আছে। কেউ কেউ বলেছেন, এটা উপমা ধরে নেয়া, আসলে আল কুরআনের মহান মর্যাদা বর্ণনা করার একটি পদ্ধতি মাত্র যাতে মুবালাগা বা বর্ণনাধিক্যতা থাকে।
‘আল্লামা তুরবিশ্তী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হলো যদি একটি চামড়ায় কুরআনুল কারীম রাখার কারণে কুরআনুল কারীমের সংস্পর্শের বারাকাত চামড়ায় আগুন স্পর্শ করতে না পারে তাহলে কুরআনুল কারীমের হাফেয এবং সর্বদা তার তিলাওয়াতকারী মু’মিনের অবস্থা কি হতে পারে। এটাই বুঝানো উদ্দেশ্য। এখানে আগুন দ্বারা ঐ আগুন উদ্দেশ্য যা সূরা আল হুমাযাহ্’য় বর্ণিত হয়েছে।
২১৪১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৪১
وَعَنْ عَلِىَّ بْنَ أَبِىْ طَالِبٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: مَنْ قَرَأَ الْقُرْاٰنَ فَاسْتَظْهَرَه فَأَحَلَّ حَلَالَه وَحَرَّمَ حَرَامَه أَدْخَلَهُ اللّٰهُ بِهِ الْجَنَّةَ وَشَفَّعَه فِىْ عَشَرَةٍ مِنْ أَهْلِ بَيْتِه كُلِّهِمْ قَدْ وَجَبَتْ لَهُ النَّارُ. رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِىُّ وَابْنُ مَاجَهْ وَالدَّارِمِىُّ وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ: هٰذَا حَدِيثٌ غَرِيْبٌ وَحَفْصُ بْنُ سُلَيْمَانَ الرَّاوِىْ لَيْسَ هُوَ بِالْقَوِىِّ يَضْعُفُ فِى الْحَدِيثِ
আলী ইবনু আবূ ত্বলিব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে ও একে মুখস্থ করে, এর হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম মেনে চলে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তার পরিবারের এমন দশ ব্যক্তির জন্য তার সুপারিশ কবূল করবেন, যাদের প্রত্যেকেরই নিশ্চিত ছিল জাহান্নাম। (আহমদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ ও দারিমী। কিন্তু ইমাম তিরমিযী বলেছেন, এ হাদীসটি গরীব। এর একজন বর্ণনাকারী হাফস ইবনু সুলায়মান হাদীস বর্ণনায় দুর্বল।)[১]
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এ হাদীস তাদের কথাকে রদ করে যারা ধারণা করে থাকে যে, শাফা‘আত হবে শুধু মর্যাদা সমুন্নত করার জন্য; মানুষের পাপের বোঝা অপসারণের জন্য নয়। এই ভিত্তিতে তারা এটাও বলে থাকে যে, মুরতাকিবে কাবায়ির দ্বারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হয় তার ক্ষমার কোন সম্ভাবনাই নেই। জাহান্নাম যার ওপর ওয়াজিব হয়েছিল এমন ব্যক্তিকে সুপারিশ করবে। এই ওয়াজিব বলতে এখানে সিদ্ধান্ত হওয়া, অর্থাৎ- যার জন্য জাহান্নামের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল।
২১৪২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৪২
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ قَالَ لِأُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ: «كَيْفَ تَقْرَأُ فِى الصَّلَاةِ؟» فَقَرَأَ أُمَّ الْقُرْاٰنِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِه مَا أُنْزِلَتْ فِى التَّوْرَاةِ وَلَا فِى الْإِنْجِيْلِ وَلَا فِى الزَّبُوْرِ وَلَا فِى الْفرْقَانِ مِثْلُهَا وَإِنَّهَا سَبْعٌ مِنَ الْمَثَانِىْ وَالْقُرْاٰنُ الْعَظِيمُ الَّذِىْ أُعْطِيتُه». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَرَوَى الدَّارِمِىُّ مِنْ قَوْلِه: «مَا أُنْزِلَتْ» وَلَمْ يَذْكُرْ أُبَىُّ بْنُ كَعْبٍ. وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ هٰذَا حَدِيْثٌ حَسَنٌ صَحِيْحٌ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার উবাই ইবনু কা‘বকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সলাতে কিভাবে কুরআন পড়ো? উত্তরে উবাই ইবনু কা‘ব রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সূরা আল ফাতিহাহ্ পড়ে শুনালেন। (তাঁর পড়া শুনে) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আল্লাহর কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন! এর মতো কোন সূরা তাওরাত, ইঞ্জীল, যাবূর বা ফুরকান-এ (কুরআনের অন্য কোন সূরাতেও) নাযিল হয়নি। এ সূরা হলো সাব্‘উল মাসানী (পুনরাবৃত্ত সাতটি আয়াত) ও মহান কুরআন। এটি আমাকেই দেয়া হয়েছে। (তিরমিযী। তিনি বলেন, এ হাদীসটি হাসান ও সহীহ। দারিমী বর্ণনা করেছেন, এর মতো কোন সূরা নাযিল করা হয়নি। তাঁর বর্ণনায় হাদীসের শেষের দিক ও উপরের বর্ণিত উবাই-এর ঘটনা বর্ণিত হয়নি।)[১]
প্রশ্ন করা হয়েছিল মুত্বলাক কুরআন পাঠের উপর তিনি জওয়াব দিলেন সূরা আল ফাতিহাহ্ পাঠ করে আর তা এজন্য যে, এটি একটি জামি' সূরা এবং এটি আল কুরআনের মূল ভিত্তি। এর সমতুল্য কোন সূরা তাওরাত, যাবূর, ইঞ্জীলে তো নেই-ই এমনকি কুরআনের বাকী অংশেও নেই। কোন নাবীকেই এর সমতুল্য কোন সূরা দেয়া হয়নি। এ হলো সাব্‘উল মাসানী বা পুনঃপঠিত সপ্ত আয়াত এবং কুরআনে ‘আযীম বা মহা কুরআন।
২১৪৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৪৩
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «تَعَلَّمُوا الْقُرْاٰنَ فَاقْرَءُوهُ فَإِنَّ مَثَلَ الْقُرْاٰنِ لِمَنْ تَعَلَّمَ وَقَامَ بِه كَمَثَلِ جِرَابٍ مَحْشُوِّ مِسْكًا. تَفُوْحُ رِيحُه كُلَّ مَكَانٍ وَمَثَلُ مَنْ تَعَلَّمَه فَرَقَدَ وَهُوَ فِىْ جَوْفِه كَمَثَلِ جِرَابٍ أُوكِئَ عَلٰى مِسْكٍ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَالنَّسَائِىِّ وَابْنُ مَاجَهْ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআন শিক্ষা করো ও পড়তে থাকো। যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে এবং কুরআন নিয়ে রাতে সলাতে দাঁড়ায় তার দৃষ্টান্ত মিশক ভর্তি থলির মতো যা চারদিকে সুগন্ধি ছড়ায়। যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে তা পেটে নিয়ে রাতে ঘুমায়, তার দৃষ্টান্ত ওই মিশকপূর্ণ থলির মতো যার মুখ ঢাকনি দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। (তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ)[১]
হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘোষণাঃ ‘‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর’’, এ নির্দেশ সার্বজনীন। সুতরাং সকল উম্মাত এর অন্তর্ভুক্ত; তারা যেখানেই থাকুক পর্যায়ক্রমে কুরআন শিক্ষা করবে। যাতে কেউ কুরআন বিকৃত করতে না পারে; কেউ যদি বিকৃত করতে চেষ্টা করে তাতে বাধা দিবে।
কুরআন শিক্ষার সাথে সাথে সর্বদা তা তিলাওয়াত বা পাঠের নির্দেশ এসেছে।
কুরআন শিক্ষাকারী, তার তিলাওয়াতকারী এবং তা নিয়ে তাহাজ্জুদে দন্ডায়মানকারী, অর্থাৎ- তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াতকারীর দৃষ্টান্ত হলো মিসক ভর্তি থলির ন্যায়। এ থলির মুখ খোলা, সুতরাং তার সুগন্ধ মালিক নিজেও উপকৃত ও প্রীত হয় অপরেও উপকৃত হয়। পক্ষান্তরে যে কুরআন শিক্ষা করেছে বটে কিন্তু সে তা কোন সময় তিলাওয়াত করে না এবং তা দিয়ে তাহাজ্জুদও পড়ে না তার দৃষ্টান্ত হলো মুখ বন্ধ মিসকের থলির ন্যায়। যার (বদ্ধ) সুগন্ধি কেউই পায় না এবং তা দ্বারা উপকৃতও হয় না।
২১৪৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৪৪
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: مَنْ قَرَأَ ﴿حٰمٓ﴾ الْمُؤْمِنَ إِلٰى (إِلَيْهِ الْمَصِيرُ). وَاٰيَةَ الْكُرْسِىِّ حِينَ يُصْبِحُ حُفِظَ بِهِمَا حَتّٰى يُمْسِىَ. وَمَنْ قَرَأَ بِهِمَا حِينَ يُمْسِىْ حُفِظَ بِهِمَا حَتّٰى يَصْبَحَ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَالدَّرِامِىُّ وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ هٰذَا حَدِيْثٌ غَرِيْبٌ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সকালে সূরা হা-মীম ‘‘আল মু’মিন..... ইলায়হিল মাসীর’’ পর্যন্ত ও আয়াতুল কুরসী পড়বে, তাকে এর বারাকাতে সন্ধ্যা পর্যন্ত হিফাযাতে রাখা হবে। আর যে ব্যক্তি তা সন্ধ্যায় পড়বে তাকে সকাল পর্যন্ত নিরাপদ রাখা হবে- (তিরমিযী ও দারিমী। কিন্তু ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি গরীব।)[১]
দারিমীর বর্ণনায় এ কথাও আছে, সে সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত এবং সন্ধা থেকে সারা রাত কোন অপছন্দনীয় বিষয় দেখবে না। বিপদ মুসীবাত দুঃখ-বেদনা ইত্যাদি থেকে সে নিরাপদে থাকবে।
২১৪৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৪৫
وَعَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «إِنَّ اللّٰهَ كَتَبَ كِتَابًا قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ بِأَلْفَىْ عَامٍ أَنْزَلَ مِنْهُ اٰيَتَيْنِ خَتَمَ بِهِمَا سُورَةَ الْبَقَرَةِ وَلَا تُقْرَاٰنِ فِىْ دَارٍ ثَلَاثَ لَيَالٍ فَيَقْرَبَهَا الشَّيْطَانُ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَالدَّارِمِىُّ وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ: هٰذَا حَدِيثٌ غَرِيْبٌ
নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করার দু’ হাজার বছর আগে আল্লাহ তা‘আলা একটি কিতাব লিখেছেন। এ কিতাব হতে পরবর্তীতে দু’টি আয়াত নাযিল করেছেন যা দ্বারা সূরা আল বাকারাহ্ শেষ করেছেন। কোন ঘরে তা তিন রাত পড়া হবে, অথচ এরপরও এ ঘরের কাছে শয়তান যাবে, এমনটা হতে পারে না। (তিরমিযী ও দারিমী। কিন্তু ইমাম তিরমিযী বলেছেন, হাদীসটি গরীব।)[১]
এজন্য মুহাদ্দিসীনগণ এটাকে মুসলিমে বর্ণিত ‘‘আল্লাহ তা‘আলা আসমান জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে তাকদীর বা সৃষ্টির নির্ধারিত বিষয় লিখে রেখেছেন’’, এ হাদীসকে ঐ কথার বিরোধী মনে করেন না। কেননা মূল তাকদীর আল্লাহ তা‘আলা পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই লাওহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন। অতঃপর আসমান জমিন সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্বে (আল্লাহ তা‘আলা) মালায়িকাহ্’র (ফেরেশতাদের) নির্দেশ করেন, তারা তা খণ্ড খণ্ড বা আলাদা আলাদাভাবে লিপিবদ্ধ করে ফেলেন।
অথবা তাকদীর আল্লাহ তা‘আলা একবারেই লিখে ফেলেননি বরং পর্যায়ক্রমে লিখতে লিখতে কোনটি পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে কোনটা দুই হাজার বছর পূর্বে লিখেছেন, সুতরাং দুই হাদীসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
কেউ বলেছেন, এখানে الكتابة লিখা الاظهار প্রকাশ অর্থে ব্যবহার হয়েছে।
অতএব, পরস্পর বিরোধপূর্ণ দু’ হাদীসের সমন্বয়ী অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলা আসমান জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই তাকদীর লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, অতঃপর আসমান জমিন সৃষ্টির দু’ হাজার বছর পূর্বে তা এক শ্রেণীর মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)’র নিকট اظهار বা প্রকাশ করেছেন। অত্র হাদীসে সেটাই বলা হয়েছে।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, সম্ভবতঃ এর সার কথা এই যে, পৃথিবীতে যা কিছু হবে তা আসমান জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। লাওহে মাহফূযে পবিত্র কুরআনুল কারীমের লিপিবদ্ধও এর অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা কিছু মালাক (ফেরেশতা) এবং অন্যান্য কিছু সৃষ্টি করলেন, এরপর আসমান জমিন সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্বে তাদের নিকট কুরআনুল কারীমের লিখনী প্রকাশ করলেন।
লাওহে মাহফূযে লিখিত বা রক্ষিত পবিত্র কুরআনুল কারীম থেকে আল্লাহ তা‘আলা দু’টি আয়াত নাযিল করেছেন। এ দু’টি আয়াত হলো সূরা আল বাকারাহ্’র শেষ দু’টি আয়াত। কোন ঘরে বা বাড়িতে যদি এ দু’টি আয়াত একাধারে তিনদিন তিলাওয়াত করা হয় এবং এর সাথে অতীব মহিমান্বিত সূরা আল ফাতিহাহ্ পাঠ করা হয় তাহলে সেখানে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না।
২১৪৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৪৬
وَعَن أبِى الدَّرْدَاء قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَنْ قَرَأَ ثَلَاثَ اٰيَاتٍ مِنْ أَوَّلِ الْكَهْفِ عُصِمَ مِنْ فِتْنَةِ الدَّجَّالِ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَقَالَ: هٰذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ
আবূ দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সূরা আল কাহাফ-এর প্রথম দিকের তিনটি আয়াত পড়বে, তাকে দাজ্জালের ফিতনা হতে নিরাপদ রাখা হবে। (তিরমিযী। তিনি বলেন, এ হাদীসটি হাসান ও সহীহ।)[১]
২১৪৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৪৭
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «إِنَّ لِكُلِّ شَىْءٍ قَلْبًا وَقَلْبُ الْقُرْاٰنِ ﴿يٰسٓ﴾ وَمَنْ قَرَأَ ﴿يٰسٓ﴾ كَتَبَ اللّٰهُ لَه بِقِرَاءَتِهَا قِرَاءَةَ الْقُرْاٰنِ عَشْرَ مَرَّاتٍ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَالدَّارِمِىُّ وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ هٰذَا حَدِيثٌ غَرِيْبٌ
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক জিনিসের ‘কলব’ (হৃদয়) আছে। কুরআনের ‘কলব’ হলো, ‘সূরা ইয়াসীন’। যে ব্যক্তি এ সূরা একবার পড়বে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য একবার পড়ার কারণে দশবার কুরআন পড়ার সাওয়াব লিখবেন। (তিরমিযী, দারিমী। ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটিকে গরীব বলেছেন।)[১]
ইমাম গাযালী (রহঃ) বলেন, হাশর-নাশরের স্বীকৃতির উপর ঈমানের বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয়, এ সূরায় এটা পূর্ণমাত্রায় রয়েছে। এ কারণেই এ সূরাকে কুরআনের কলব বলা হয়েছে।
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী এটিকে একটি উত্তম ব্যাখ্যা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি স্বীয় লুম্‘আত গ্রন্থে বলেন, কোন বস্ত্তর কলব হলো তার মাখন সদৃশ, সুতরাং সূরাটি আকারে ছোট হলেও তা আল কুরআনের পূর্ণ মাকাসিদ বা উদ্দেশাবলীর ক্ষেত্রে মাখন সদৃশ। আল্লাহর হাতেই এ ক্ষমতা এবং তারই ইচ্ছা, তিনি যে বস্ত্ততে ইচ্ছা বিশেষ মর্যাদা ও বিশেষত্ব দান করে থাকেন। যেমন লায়লাতুল কদরকে সকল সময়ের উপর বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। এমনভাবেই আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াতের অতিরিক্ত বা বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন।
২১৪৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৪৮
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «إِنَّ اللّٰهَ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى قَرَأَ ﴿طٰهٰ﴾ و ﴿يٰسٓ﴾ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ بِأَلْفِ عَامٍ فَلَمَّا سَمِعَتِ الْمَلَائِكَةُ الْقُرْاٰنَ قَالَتْ طُوبٰى لِأُمَّةٍ يَنْزَلُ هٰذَا عَلَيْهَا وَطُوبٰى لِأَجْوَافٍ تَحْمِلُ هٰذَا وَطُوبٰى لِأَلْسِنَةٍ تَتَكَلَّمُ بِهٰذَا». رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা আসমান ও জমিন সৃষ্টির এক হাজার বছর পূর্বে সূরা ত্ব-হা- ও সূরা ইয়াসীন পাঠ করলেন। মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) (ফেরেশতাগণ) তা শুনে বললেন, ধন্য সে জাতি যাদের ওপর এ সূরা নাযিল হবে। ধন্য সে পেট যে এ সূরা ধারণ করবে। ধন্য সে মুখ (জিহবা), যে তা উচ্চারণ করবে। (দারিমী)[১]
মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলে, এর অর্থ হলো তিনি এর কিরাআতকে প্রকাশ করলেন এবং তা তিলাওয়াতের সাওয়াব বর্ণনা করলেন।
ইবনুল মালিক (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলা মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)’র সূরা দু’টি বুঝালেন এবং তাদের অন্তরে তার অর্থ ইলহাম করলেন।
ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হলো এ সূরা দ্বয়ের মর্যাদা জানানোর জন্য কতিপয় মালাককে (ফেরেশতাকে) বাকী অন্য সকল মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)’র নিকট পাঠ করে শুনানোর জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ করলেন। অথবা এর প্রকাশ্য অর্থের উপর রাখার সম্ভাবনাও রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এ দু’টি সূরার সম্মান ও মর্যাদার কারণে স্বীয় কালামকে কালামে নাফসী হিসেবে শুনিয়েছেন। শুনানোর এই পদ্ধতিকেই কিরাআত বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন কালামে নাফসীকেই প্রকৃত কুরআন বলে নামকরণ করা হয়।
শায়খুল হাদীস ‘আল্লামা মুবারকপূরী (রহঃ) বলেন, এ হাদীসের তা‘বীল করে প্রকাশ্য অর্থ থেকে ঐ রূপক অর্থের দিকে ফিরিয়ে নেয়ার কোনই প্রয়োজন নেই বরং প্রকাশ্য অর্থের উপর রাখাই নির্ধারিত।
সূরা ত্ব-হা- এবং সূরা ইয়াসীন নিঃসন্দেহে কুরআনের অংশ, আর কুরআন আল্লাহর কালাম, তা মাখলূক বা সৃষ্ট নয়। আল্লাহ তা‘আলা সর্বদাই মুতাকাল্লিম বা কালাম কারী, যখন তিনি চান এবং যেভাবে চান, তবে কোন বস্ত্তই তার তুল্য নয়। কালামে নাফসী দ্বারা তিনি শুনিয়েছেন মর্মে কারীর ঐ তা‘বীল দলীলবিহীন কথা। না তা কুরআনে আছে, না হাদীসে আছে, এমনকি কোন সাহাবীর কথায়ও নেই, সুতরাং হাদীসের প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করাই সঠিক এবং সুনির্ধারিত।
‘‘মালায়িকাহ্ যখন কুরআন পাঠ শুনতে পেল’’, হাদীসের এ বাক্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আসমান জমিন সৃষ্টির অনেক আগেই আল্লাহ তা‘আলা মালাক সৃষ্টি করেছেন।
কেউ কেউ বলেছেন, কুরআন দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মাসদার, অর্থাৎ- কিরাআত, আহলে ‘আরবগণ বলে থাকে (قرأت الكتاب قراءة وقرآناً)। কেউ বলেছেন, তার উদ্দেশ্য হলো আল কুরআন, অর্থাৎ- স্বয়ং কালাম মাসদার নয়। যেখানে কুরআন শব্দ উল্লেখ হয় এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয় নাফসুল কালাম বা স্বয়ং কালাম। উদ্দেশ্য হলো তার দ্বারা কথা বলা এবং তার কিরাআত পাঠ করা। এই ভিত্তিতেই ত্ব-হা এবং ইয়াসীন সূরা দ্বয়ের মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা বা প্রমাণের জন্য কুরআনকে ঐ দু’টি সূরার উপর ইতলাক করেছেন।
কেউ কেউ বলেছেন, এটা মূলত মূলকে অংশের উপর ইতলাক করা হয়েছে। কেননা আল কুরআনের আলোচ্য বিষয়ের পরিমাণ পূর্ণ এবং অংশের সমভিব্যাহারেই সম্পাদিত।
কেউ বলেছেন, আল কুরআন পূর্ণটাই উদ্দেশ্য কিন্তু মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) যখন সূরা ত্ব-হা- এবং ইয়াসীন শুনলো তখন এর মর্যাদা দেখে তারা বলল, (طُوبٰى) ধন্য সে জাতি যাদের নিকট এটা নাযিল হবে এবং ধন্য ঐ যে তা স্বীয় বক্ষে ধারণ করবে, অর্থাৎ- মুখস্থ করবে এবং ধন্য ঐ মুখ যে তা পাঠ করবে। طُوبٰى ‘তূবা’ শব্দের অর্থ الراحة আনন্দ, প্রশান্তি, অবকাশ। এখানে সুসংবাদ, ধন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
কেউ কেউ বলেছেন, طُوبٰى হলো জান্নাতের একটি বৃক্ষ জান্নাতে অবস্থিত প্রত্যেক বাড়ির সামনেই এ বৃক্ষটি থাকবে, তা হবে ডাল-পালা পত্র-পল্লবে সুশোভিত।
২১৪৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৪৯
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَنْ قَرَأَ ﴿حٰمٓ﴾ الدُّخَانِ فِىْ لَيْلَةٍ أَصْبَحَ يَسْتَغْفِرُ لَه سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَقَالَ: هٰذَا حَدِيْثٌ غَرِيْبٌ وَعَمْرُ بْنُ أبِىْ خَثْعَمٍ الرَّاوِي يُضَعَّفُ وَقَالَ مُحَمَّدٌ يَعْنِى الْبُخَارِىَّ هُوَ مُنْكَرُ الحَدِيْثِ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি রাতে সূরা ‘হা-মীম’ আদ্ দুখা-ন পড়ে। তার সকাল এভাবে হয় যে সত্তর হাজার মালাক (ফেরেশতা) আল্লাহর নিকট তার জন্য মাগফিরাত চাইতে থাকেন। (তিরমিযী। তিনি বলেন, এ হাদীসটি গরীব। একজন বর্ণনাকারী ‘আমর ইবনু আবূ খাস্‘আম য‘ঈফ। ইমাম বুখারী বলেছেন, ‘আমর একজন মুনকার রাবী।)[১]
লুম্‘আত গ্রন্থকার বলেন, প্রথম হাদীসে রাতের নির্দিষ্টতা অস্পষ্ট কিন্তু দ্বিতীয় হাদীসে রাতের নির্দিষ্টতা সুস্পষ্ট। তাই নির্দিষ্ট রাত উল্লেখ সম্বলিত হাদীসের ভিত্তিতে জুমার রাতে পড়াই উত্তম, যাতে হাদীসের বিশেষ ফাযীলাত নিশ্চিতভাবে অর্জিত হয়।
২১৫০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৫০
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَنْ قَرَأَ ﴿حٰمٓ﴾ الدُّخَانِ فِىْ لَيْلَةِ الْجُمْعَةِ غُفِرَ لَه». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَقَالَ: هٰذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ وَهِشَام أَبُو الْمِقْدَام الرَّاوِىْ يُضَعَّفُ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জুমার রাতে সূরা ‘হা-মীম আদ্ দুখা-ন’ পড়বে তাকে মাফ করে দেয়া হবে। (তিরমিযী। তিনি বলেছেন, এ হাদীসটি গরীব। এর রাবী আবূল মিকদাম হিশাম কে দুর্বল বলা হয়েছে।)[১]
২১৫১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৫১
وَعَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ كَانَ يَقْرَأُ الْمُسَبِّحَاتِ قَبْلَ أَنْ يَرْقُدَ يَقُولُ: «إِنَّ فِيهِنَّ اٰيَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ اٰيَةٍ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَأَبُو دَاوُدَ
‘ইরবায্ ইবনু সারিয়াহ্ থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয়নের আগে ‘মুসাব্বিহাত’ পাঠ করতেন। তিনি বলতেন, ঐ আয়াতসমূহের মধ্যে এমন একটি আয়াত রয়েছে যা হাজারটি আয়াতের চেয়েও উত্তম। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ)[১]
২১৫২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৫২
وَرَوَاهُ الدَّارِمِىُّ عَنْ خَالِدِ بْنِ مَعْدَانَ مُرْسَلًا وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ: هٰذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ
দারিমী মুরসাল থেকে বর্ণিতঃ
হাদীস হিসেবে খালিদ ইবনু মা‘দান (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেছেন, হাদীসটি হাসান গরীব।[১]
এ সূরাগুলোর মধ্যে এমন একটি আয়াত রয়েছে যা হাজার আয়াত অপেক্ষাও উত্তম, সে আয়াত কোনটি? এ নিয়ে মনীষীদের বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে।
কেউ বলেছেন, সেই ফাযীলাতপূর্ণ আয়াতটি হলো, ...لَوْ أَنْزَلْنَا هٰذَا الْقُرْآنَ এ আয়াতটি আল্লাহ তা‘আলার ইসমে আ‘যম এর ন্যায়, যা অন্যান্য নামের উপর বিশেষ মর্যাদা রাখে।
হাফেয ইমাদুদ্দীন ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, সে আয়াতটি হলো,
﴿هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيمٌ﴾
মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) বলেন, ওটা ঐ আয়াত যার শুরুতে আত্ তাসবীহ রয়েছে।
‘আল্লামা ত্বীবী বলেন, এ আয়াতটি লায়লাতুল কদরের ন্যায় এবং জুমার দিনে দু‘আ কবূল হওয়ার মোক্ষম মুহূর্তের ন্যায় গোপন রাখা হয়েছে, যাতে করে মানুষ তা পাওয়ার আশায় সবই তিলাওয়াত করে ফেলে।
২১৫৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৫৩
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: إِنَّ سُورَةً فِى الْقُرْاٰنِ ثَلَاثُونَ اٰيَةً شَفَعَتْ لِرَجُلٍ حَتّٰى غُفِرَ لَه وَهِىَ: ﴿تَبَارَكَ الَّذِىْ بِيَدِهِ الْمُلْكُ﴾ رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِىُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِىُّ وَابْنُ مَاجَهْ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআনে ত্রিশ আয়াতের একটি সূরা আছে, যা এক ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করেছে। ফলে তাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে। সে সূরাটি হচ্ছে, ‘তাবা-রাকাল্লাযী বিইয়াদিহিল মুলক’। (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ)[১]
২১৫৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৫৪
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: ضَرَبَ بَعْضُ أَصْحَابِ النَّبِىِّ ﷺ خِبَاءَه عَلٰى قَبْرٍ وَهُوَ لَا يَحْسَبُ أَنَّه قَبْرٌ فَإِذَا فِيهِ إِنْسَان يَقْرَأُ سُوْرَةَ ﴿تَبَارَكَ الَّذِىْ بِيَدِهِ الْمُلْكُ﴾ حَتّٰى خَتَمَهَا فَأَتَى النَّبِىَّ ﷺ فَأَخْبَرَه فَقَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «هِيَ الْمَانِعَةُ هِيَ الْمُنْجِيَةُ تُنْجِيهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْر». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَقَالَ: هٰذَا حَدِيْثٌ غَرِيْبٌ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একবার নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোন এক সাহাবী না জেনে কোন একটি কবরের উপর তাঁবু খাটালেন। তিনি হঠাৎ দেখেন, এ কবরে এক ব্যক্তি সূরা ‘তাবা-রাকাল্লাযী বিইয়াদিহিল মুলক’ পড়ছে এমনকি তা শেষ করে ফেলেছে। এরপর ওই সাহাবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে তাঁকে এ খবর জানালেন। তিনি বললেন, এটা হচ্ছে (‘আযাব হতে) বাধাদানকারী এবং মুক্তিদানকারী। যা পাঠককে আল্লাহ তা‘আলার ‘আযাব থেকে মুক্তি দিয়ে থাকে। (তিরমিযী; তিনি বলেছেন, হাদীসটি গরীব)[১]
এ লোকটি কি ঐ কবরবাসী, না মালাক (ফেরেশতা)? এ প্রশ্নের তিনটি মত পাওয়া যায়। কেউ বলেছেন, ঐ কবরবাসীই পাঠ করেছিলেন, কেউ বলেছেন, মালাক মানুষরূপ ধরে কবরে কুরআন তিলাওয়াত করেছিলেন। কেউ আবার বলেছেন, সূরা মুলক-কে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের রূপ দিয়ে তিলাওয়াত করাতেন।
এ পড়া কোন সাওয়াবের উদ্দেশে নয়, বরং ঐ লোকটি দুনিয়ায় এ সূরাটি অধিক তিলাওয়াত করতেন এবং ভালোবাসতেন। সুতরাং ঐ ভালোবাসার স্মৃতি রক্ষার্থে এবং ঐ সূরার স্বাদ অনুভবকল্পে আল্লাহ তা‘আলা তার কব্রে ঐ সূরা শোনানোর ব্যবস্থা করেছেন।
এ সূরার নাম দেয়া হয়েছে মুনযিয়্যাহ্, মানিআহ্ মুক্তি দানকারী ও বাধাদানকারী। এর অর্থ হলো এ সূরা তার তিলাওয়াতকারীকে কবরের ‘আযাব থেকে বাধাদানকারী হবে এবং জাহান্নাম ও আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তিদানকারী হবে।
২১৫৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৫৫
وَعَنْ جَابِرٍ أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ كَانَ لَا يَنَامُ حَتّٰى يَقْرَأَ: ﴿الٓمٓ تَنْزِيْلُ﴾ وَ ﴿تَبَارَكَ الَّذِىْ بِيَدِهِ الْمُلْكُ﴾ رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِىُّ وَالدَّارِمِىُّ. وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ: هٰذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ. وَكَذَا فِىْ شَرْحِ السُّنَّةِ. وَفِى الْمَصَابِيْحِ : غَرِيْبٌ
জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (ঘুমানোর জন্য বিছানায় শোবার পর) যে পর্যন্ত সূরা ‘আলিফ লা-ল মীম্ তানযীল’ ও সূরা ‘তাবা-রকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলক’ পড়ে শেষ না করতেন ঘুমাতেন না। (আহমদ, তিরমিযী ও দারিমী। ইমাম তিরমিযী বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। ‘শারহুস্ সুন্নাহ্’য় এরূপ রয়েছে, মাসাবীহ এ হাদীসকে গরীব বলেছেন।)[১]
হাদীসের উদ্দেশিত অর্থ হলো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যখন নিদ্রা যাওয়ার সময় হতো তিনি এ দু’টি সূরা না পড়ে নিদ্রা যেতেন না। অথবা তাঁর পাঠের আগে নিদ্রা যাওয়ার অভ্যাস ছিল না, তা নিদ্রার পূর্ব মুহূর্তে হোক অথবা খানিক আগেই হোক। মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) এ দ্বিতীয় অর্থটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
২১৫৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৫৬
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ وَأَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمْ قَالَا: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: ﴿إِذَا زُلْزِلَتِ﴾ تَعْدِلُ نِصْفَ الْقُرْاٰنِ، وَ ﴿قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ﴾. تَعْدِلُ ثُلُثُ الْقُرْاٰنِ، وَ ﴿قُلْ يٰاَ أَيُّهَا الْكٰفِرُوْنَ﴾. تَعْدِلُ رُبْعَ الْقُرْاٰنِ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস ও আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
দু’জনেই বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ (সাওয়াবের দিক দিয়ে) সূরা ‘ইযা- যুলযিলাত’ কুরআনের অর্ধেকের সমান, ‘কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ’ (কুরআনের) এক-তৃতীয়াংশের সমান, ‘কুল ইয়া- আইয়ুহাল কা-ফিরূন’ এক-চতুর্থাংশের সমান। (তিরমিযী)[১]
যেমন বলা হয়েছে সূরা যিলযাল কুরআনের অর্ধেকের সমান এজন্য যে, কুরআনের বিষয়বস্তুকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়, একটি হলো আহকামুদ্ দুন্ইয়া, আরেকটি হলো আহকামুল আ-খিরাহ্। এ সূরাটিতে ইজমালান সমগ্র আহকামুল আ-খিরাহ্ তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং তা যেন কুরআনের অর্ধেক।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এখানে আল কুরআনের ‘‘মাকসূদুল আ‘যম বিযযা-ত’’ (সত্তাগত মহান) উদ্দেশ্য হতে পারে। সেটা হলো শুরু এবং শেষ অবস্থা, যদিও সূরা যিলযাল শেষ বা কিয়ামাতের অবস্থার বর্ণনা সম্বলিত একটি সূরা তথাপি আখিরাতের আহওয়াল বা অবস্থাদির উপর একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ সম্বলিত সূরা। সুতরাং এ অর্থে এ সূরাটি যেন আল কুরআনের অর্ধেকের সমান।
আবার যে সূরাটিকে কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমান বলে অভিহিত করা হয়েছে, অর্থাৎ- সূরা কাফিরূন সেটা এভাবে যে, আল কুরআনের বিবরণ হলো- ১. তাওহীদের উপর ২. নবূওয়াতের উপর ৩. জীবন-জীনদেগীর বিধানের উপর ৪. এবং পরকালীন অবস্থার উপর।
এর মধ্যে সূরা কাফিরূন প্রথমটি অর্থাৎ- তাওহীদকে অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা শির্ক থেকে বেঁচে থাকা এবং সত্য দ্বীনের উপর অবিচল থাকা- এটা তাওহীদের মূল স্বীকৃতি। সুতরাং এটি এক চতুর্থাংশের সমান।
অনুরূপ সূরা ইখলাস আল কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান। এটা এভাবে যে, আল কুরআনে তিন প্রকার ‘ইলম বর্ণিত হয়েছে। ১. ‘ইলমুত্ তাওহীদ ২. ইলমুশ্ শরায়ে ওয়াল আহকাম ৩. এবং ‘ইলমুল আখবার ওয়াল কুসাস বা ইতিহাস ও ঘটনা প্রবাহ। এ সূরাটিতে অর্থাৎ- সূরা ইখলাসে প্রথমটি অর্থাৎ- ‘ইলমুত তাওহীদ পূর্ণমাত্রায় বিধৃত হয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সূরাটি আল কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান। ইতিপূর্বে সূরা ইখলাসের আরো ব্যাখ্যা অতিবাহিত হয়েছে।
২১৫৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৫৭
وَعَنْ مَعْقِلِ بْنِ يَسَارٍ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ: «مَنْ قَالَ حِينَ يُصْبِحُ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ: أَعُوذُ بِاللّٰهِ السَّمِيعِ الْعَلِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ فَقَرَأَ ثَلَاثَ اٰيَاتٍ مِنْ اٰخِرِ سُورَةِ ﴿الْحَشْرِ﴾. وَكَّلَ اللّٰهُ بِه سَبْعِينَ أَلْفَ مَلَكٍ يُصَلُّونَ عَلَيْهِ حَتّٰى يُمْسِىَ وَإِنْ مَاتَ فِىْ ذٰلِكَ الْيَوْمِ مَاتَ شَهِيْدًا. وَمَنْ قَالَهَا حِينَ يُمْسِىْ كَانَ بِتِلْكَ الْمَنْزِلَةِ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَالدَّارِمِىُّ. وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ: هٰذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ
মা‘কিল ইবনু ইয়াসার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সকালে (ঘুম থেকে) উঠে তিনবার বলবে, ‘‘আ‘ঊযু বিল্লা-হিস সামী‘ইল ‘আলীমি মিনাশ্ শাইত্ব-নির রজীম’’ এবং এরপর সূরা হাশর-এর শেষের তিন আয়াত পড়বে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য সত্তর হাজার মালাক (ফেরেশতা) নিযুক্ত করবেন। এরা তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত দু‘আ করতে থাকবেন। যদি এ দিন সে মারা যায়, তার হবে শাহীদের মৃত্যু। যে ব্যক্তি এ দু‘আ সন্ধ্যার সময় পড়বে, সেও এ একই মর্যাদা পাবে। (তিরমিযী, দারিমী। ইমাম তিরমিযী বলেছেন, এ হাদীসটি গরীব।)[১]
কুরআনুল কারীম তিলাওয়াতের শুরুতে আ‘ঊযূবিল্লা-হ পাঠ করা হলো সূরা আন্ নাহল এর এ আয়াতের নির্দেশ পালনে, আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
‘‘যখন কুরআন পাঠ করবে তখন আ‘ঊযুবিল্লা-হ পড়ে (বিতাড়িত শয়তান থেকে) আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে।’’ (সূরা আন্ নাহল ১৬ : ৯৮)
এরপর সূরা হাশর-এর যে শেষ তিনটি আয়াত পড়ার কথা বলা হয়েছে, এ তিনটি আয়াত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক মনীষীর মতে এ তিনটি আয়াত হলো ইসমে আ‘যম সম্বলিত আয়াত। সত্তর হাজার মালাক (ফেরেশতা) তার জন্য নিযুক্ত করা হয় যারা তার ওপর সলাত পাঠ করে, এর অর্থ হলো তার নেক কাজের তাওফীকের জন্য এবং সকল প্রকার অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করার জন্য দু‘আ করে। সর্বোপরি তারা তার মাগফিরাতও কামনা করে থাকে।
২১৫৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৫৮
وَعَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ: «مَنْ قَرَأَ كُلَّ يَوْمٍ مِائَتَىْ مَرَّةٍ (﴿قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ﴾ مُحِىَ عَنْهُ ذُنُوبُ خَمْسِينَ سَنَةً إِلَّا أَنْ يَكُونَ عَلَيْهِ دَيْنٌ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَالدَّارِمِىُّ وَفِىْ رِوَايَتِه «خَمْسِينَ مَرَّةٍ» وَلَمْ يَذْكُرْ «إِلَّا أَنْ يَكُونَ عَلَيْهِ دِيْنٌ
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক দিন দু’শ বার সূরা ‘কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ’ পড়বে তার পঞ্চাশ বছরের গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হবে। যদি তার ওপর কোন ঋণের বোঝা না থাকে। (তিরমিযী ও দারিমী। কিন্তু দারিমীর বর্ণনায় [দু’শ বারের জায়গায়] পঞ্চাশ বারের কথা উল্লেখ হয়েছে। তিনি ঋণের কথা উল্লেখ করেননি।)[১]
অন্য এক বর্ণনায় পঞ্চাশবার পড়ার কথা আছে, তবে সেখানে ঋণের কথা নেই।
শায়খ ‘আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রহঃ) বলেন, ঋণের গুনাহকে ইস্তিসনা করা (অর্থাৎ- ঋণের গুনাহ ব্যতীত) কথাটির দু’টি অর্থ হতে পার।
১. ঋণের গুনাহ মুছে দেয়া হয় না এবং তাকে ক্ষমা করাও হয় না। এখানে ঋণকে গুনাহের জাতিভুক্ত করা হয়েছে ভীতিপ্রদর্শন করার জন্য এবং গুরুত্ব বুঝানোর জন্য।
২. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির গুনাহই ক্ষমা করা হয় না, সুতরাং ঐ সূরা পাঠ তার ওপর কোন প্রভাব ফেলে না। অর্থাৎ- তার গুনাহ মুছে ফেলে না।
২১৫৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৫৯
وَعَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ: «مِنْ أَرَادَ أَنْ يَنَامَ عَلٰى فِرَاشِه فَنَامَ عَلٰى يَمِينِه ثُمَّ قَرَأَ مِائَةَ مَرَّةٍ ﴿قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ﴾ إِذا كَانَ يَوْم الْقِيَامَةِ يَقُولُ لَهُ الرَّبُّ: يَا عَبْدِىْ اُدْخُلْ عَلٰى يَمِينِكَ الْجَنَّةَ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَقَالَ: هٰذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ঘুমাবার জন্য বিছানায় যাবে এবং ডান পাশের উপর শোয়ার পর একশ’ বার সূরা ‘কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ’ পড়বে, কিয়ামাতের দিন প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা তাকে বলবেন, হে আমার বান্দা! তুমি তোমার ডান দিকের জান্নাতে প্রবেশ করো। (তিরমিযী; তিনি বলেছেন, হাদীসটি হাসান তবে গরীব।)[১]
২১৬০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৬০
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ سَمِعَ رَجُلًا يَقْرَأُ ﴿قُلْ هُوَ اللّٰهُ أَحَدٌ﴾ فَقَالَ: «وَجَبَتْ» قُلْتُ: وَمَا وَجَبَتْ؟ قَالَ: «الْجَنَّةَ». رَوَاهُ مَالِكٌ وَالتِّرْمِذِىُّ وَالنَّسَائِىُّ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে ‘কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ’ পড়তে শুনে বললেন, সুনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। আমি শুনে বললাম, কি সুনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে (হে আল্লাহর রসূল) উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘জান্নাত’। (মালিক, তিরমিযী ও নাসায়ী)[১]
২১৬১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৬১
وَعَنْ فَرْوَةَ بْنِ نَوْفَلٍ عَنْ أَبِيهِ: أَنَّه قَالَ: يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ عَلِّمْنِىْ شَيْئًا أَقُولُه إِذَا أَوَيْتُ إِلٰى فِرَاشِىْ. فَقَالَ: «اقْرَأْ ﴿قُلْ يٰاَ أَيُّهَا الْكٰفِرُوْنَ﴾ فَإِنَّهَا بَرَاءَةٌ مِنَ الشِّرْكِ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَالدَّارِمِىُّ
ফারওয়াহ্ ইবনু নাওফাল (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তার পিতা নাওফাল হতে বর্ণনা করেছেন, একদিন নাওফাল (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! এমন একটি বিষয় আমাকে শিখিয়ে দিন যা আমি ঘুমাতে গিয়ে পড়তে পারি। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সূরা ‘‘কুল ইয়া- আইয়্যুহাল কা-ফিরূন’’ পড়ো। কেননা এ সূরা শির্ক হতে পবিত্র। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ, দারিমী)[১]
২১৬২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৬২
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ: بَيْنَا أَنَا أَسِيْرُ مَعَ رَسُولِ اللّٰهِ ﷺ بَيْنَ الْجُحْفَةِ وَالْأَبْوَاءِ إِذْ غَشِيَتْنَا رِيحٌ وَظُلْمَةٌ شَدِيدَةٌ فَجَعَلَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ يُعَوِّذُ ب ﴿أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ﴾ وَ ﴿أَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ﴾ وَيَقُولُ: «يَا عُقْبَةُ تَعَوَّذْ بِهِمَا فَمَا تَعَوَّذَ مُتَعَوِّذٌ بِمِثْلِهِمَا». رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ
উকবাহ্ ইবনু ‘আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একবার আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে জুহফাহ্ ও আব্ওয়া (নামক স্থানের) মধ্যবর্তী জায়গায় চলছিলাম। এ সময় প্রবল ঝড় ও ঘোর অন্ধকার আমাদেরকে ঘিরে ফেলল। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ‘‘কুল আ‘ঊযু বিরাব্বিল ফালাক’’ ও সূরা ‘‘কুল আ‘ঊযু বিরাব্বিন্না-স’’ পড়ে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে ‘উকবাহ্! এ দু’টি সূরা দ্বারা আল্লাহর আশ্রয় চাও। কারণ এ দু’ সূরার মতো অন্য কোন সূরা দিয়ে কোন প্রার্থনাকারীই আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেনি। (আবূ দাঊদ)[১]
এ স্থানের পূর্ব নাম ছিল মাহী‘আহ্ অথবা মা‘ঈশাহ্। জুহফাহ্ শব্দের অর্থ হলো মহামারী। একবার এই মা‘ঈশাহ্ গ্রামে প্রবল বন্যা দেখা দেয়, এতে মহামারী শুরু হয় সেই থেকে এ স্থানের নাম হয় জুহফাহ্ বা মহামারী কবলিত এলাকা। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনার জ্বরকে জুহ্ফায় চলে যাওয়ার জন্য দু‘আ করেছেন। জুহফায় কেউ গেলে সে জ্বরে আক্রান্ত হয়। এটা প্রাচীন সিরিয়াবাসীদের মীকাত বা ইহরাম বাঁধার স্থান। মিসর এবং পশ্চিমাদের মীকাতও এটাই। বর্তমান মিসরীগণ এখান থেকেই ইহরাম বাঁধে। রাবেগ জুহফার নিকটস্থ একটি স্থান, উভয়ের মাঝে দূরত্ব ৬/৭ মাইল মাত্র। আর আব্ওয়া হলো একটি পাহাড় যা মক্কা ও মাদীনার মাঝখানে অবস্থিত। এখানে একটি শহর গড়ে উঠেছে ঐ পাহাড়কে কেন্দ্র করেই ঐ শহরের নামকরণ করা হয়েছে আব্ওয়া। এখানে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুহতারামাহ্ জননী আমীনাহ্ ইন্তিকাল করেছেন। জুহফাহ্ এবং আব্ওয়া-এর মাঝের দূরত্ব বিশ থেকে ত্রিশ মাইল। এখানেই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভীষণ অন্ধকার এবং ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়েছিলেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সূরা আল ফালাক এবং সূরা আন্ নাস পাঠ করে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
الفلق ‘‘ফালাক’’ শব্দের অর্থ হলো সকাল। কেউ বলেছেনঃ এর অর্থ হলো- الخلق ‘‘সৃষ্টি’’। কেউ বলেছেনঃ السجين ‘‘জেলখানা, গারদখানা (অথবা জাহান্নামের একটি রূপক নাম) অথবা জাহান্নামের একটি গর্ত। কেউ কেউ ফালাক-এর অর্থ করেছেন, প্রত্যেক বস্ত্ত ফেটে কোন কিছু বের হওয়াকে। যেমন- বীজ ফেটে অঙ্কুর বের হয়, অনুরূপ রাতের অন্ধকার ফেটে প্রভাতের আলো বের হওয়াকে ফালাক বলা হয়। সুতরাং ফালাক-এর অর্থ হলো প্রভাতকাল। আশ্রয় প্রার্থনার উদ্দেশ্য হলো- ভয় থেকে নিরাপত্তায় আসা, নানা ক্ষতিকর প্রাণীর অনিষ্টতা থেকে, দুশ্চিন্তা থেকে নিশ্চিন্ত হওয়া, নিরাপদ হওয়া। যেহেতু সকাল বা প্রভাত হলে অন্ধকারের নানা ক্ষতিকর প্রাণীর ক্ষতির আশংকা ও অন্যান্য ক্ষতির আশংকা বিদূরিত হয়। সুতরাং সে প্রভাতের রবের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে।
সূরা আন্ নাসও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পাঠ করলেন, এ সূরাটিও একই উদ্দেশ্য অবতীর্ণ ও ব্যবহার হয়।
এ দু’টি সূরা সৃষ্টির অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য সবচেয়ে উত্তম সূরা। এ জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন যাদুগ্রস্ত হয়েছিলেন, তখন দু’জন মালাক (ফেরেশতা) পাঠিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাকে শিক্ষা দেন যে, এ দু’টি সূরা পড়ে তার ওপর আপতিত ও আবিষ্ট ঐ যাদুর কার্যক্রম এবং প্রভাবকে ধ্বংস করতে হবে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করলেন, ফলে তার ওপরের যাদুর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গেল এবং তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন।
২১৬৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৬৩
وَعَنْ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ خُبِيْبٍ قَالَ: خَرَجْنَا فِىْ لَيْلَةِ مَطَرٍ وَظُلْمَةٍ شَدِيدَةٍ نَطْلُبُ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ فَأَدْرَكْنَاهُ فَقَالَ: «قُلْ». قُلْتُ مَا أَقُولُ؟ قَالَ: « ﴿قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ﴾ وَالْمُعَوِّذَتَيْنِ حِينَ تُصْبِحُ وَحِينَ تُمْسِىْ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ تَكْفِيكَ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِىُّ
‘আবদুল্লাহ ইবনু খুবায়ব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা একবার ঝড়-বৃষ্টি ও ঘনঘোর অন্ধকারময় রাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খোঁজে বের হলাম এবং তাঁকে খুঁজে পেলাম। (তিনি আমাদেরকে দেখে) তখন বললেন, পড়ো! আমি বললাম, কি পড়বো (হে আল্লাহর রসূল!)? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সকালে ও সন্ধ্যায় তিনবার করে কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ, ক্বুল আ‘ঊযু বিরাব্বিল ফালাক ও ক্বুল আ‘ঊযু বিরাব্বিন্না-স পড়বে। এ সূরাহগুলো সকল বিপদাপদের মুকাবিলায় তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও নাসায়ী)[১]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী- (تَكْفِيكَ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ) -এর ব্যাখ্যায় ‘আল্লামা ত্বীবী বলেন, تدفع عنك كل سوء অর্থাৎ- তোমা থেকে সকল প্রকার অনিষ্টতা দূর করবে, তোমাকে রক্ষা করবে। مِنْ অব্যয়টি যায়িদাহ্ বা অতিরিক্ত হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। এটা জমহূর বা অধিকাংশের মত। مِنْ অব্যয়টি ابتداء الغاية প্রারম্ভিক স্থান বুঝানোর জন্যও হতে পারে। কেউ কেউ এটাকে تبعيض বা আংশিক অর্থেও হতে পারে বলে উক্তি করেছেন। সর্বসাকুল্যে কথা হলো, তোমাকে এ সূরাহ্গুলো পাঠে অন্যান্য সূরা থেকে অমুখাপেক্ষী করবে যা পাঠ করে মানুষ ক্ষতিকর কোন কিছু থেকে বাঁচতে চায়।
২১৬৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৬৪
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ: قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ أَقْرَأُ سُورَةَ (هُودٍ) أَوْ سُورَةَ (يُوسُفَ)؟ قَالَ: لَنْ تَقْرَأَ شَيْئًا أَبْلَغَ عِنْدَ اللّٰهِ مِنْ ﴿قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ﴾ رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالنَّسَائِيّ والدَّارِمِىُّ
উকবাহ্ ইবনু ‘আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একদা আমি (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে) বললাম, হে আল্লাহর রসূল! (বিপদাপদে পড়লে) আমি কি ‘সূরা হূদ’ পড়ব, না ‘সূরা ইউসুফ’? তিনি উত্তরে বললেন, এ ক্ষেত্রে তুমি আল্লাহর কাছে ক্বুল আ‘ঊযু বিরাব্বিল ফালাক-এর চেয়ে উত্তম কোন সূরা পড়তে পারবে না। (আহমাদ, নাসায়ী ও দারিমী)[১]
২১৬৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৬৫
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «أَعْرِبُوا الْقُرْاٰنَ وَاتَّبِعُوا غَرَائِبَه وَغَرَائِبُه فَرَائِضُه وَحُدُودُه». رَوَاهُ الْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيمَانِ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআন স্পষ্ট ও শুদ্ধ করে পড়ো। এর ‘গারায়িব’ অনুসরণ করো। আর কুরআনের ‘গারায়িব’ হলো এর ফারায়িয ও হুদূদ (সীমা ও বিধানসমূহ)। (ইমাম বায়হাক্বী তাঁর শু‘আবূল ঈমান-এ বর্ণনা করেছেন)[১]
‘আল্লামা ত্বীবী ফারায়িযের দ্বারা মীরাসসমূহ এবং হুদূদ দ্বারা হুদূদুল আহকাম বুঝিয়েছেন।
অথবা ফারায়িয দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ما يجب على المكلف একজন মুকাল্লাফের ওপর যা করণীয়। আর হুদূদ দ্বারা আল কুরআনের সূক্ষ্ম তত্ত্ব ও গূঢ় রহস্য এবং ভেদ কথা সম্পর্কে অবহিত হওয়া।
এ ব্যাখ্যাটি আল কুরআন সম্পর্কে বর্ণিত এ হাদীসের অতীব নিকটবর্তী; হাদীসঃ (أنزل القرآن على سبعة أحرف لكل آية منها ظهر وبطن) আল কুরআনকে সাতটি ভাষায় নাযিল করা হয়েছে, প্রত্যেকটি আয়াতের বাহির এবং ভিতর রয়েছে। (أَعْرِبُوا الْقُرْآنَ) এ কথার দিকেই ইশারা করছে যে, এর একটি বাহির আছে। এর ফারায়িয ও হুদূদ হলো ওর ভিতরের বস্ত্ত।
মুল্লা ‘আলী আল কারী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হলোঃ আল কুরআনের আয়াতসমূহের দুর্লভ দিকদর্শন, গারায়িবুল আহকাম, বিস্ময়কর নির্দেশ, সকল মু‘জিযার উপর চ্যালেঞ্জময় এর মু‘জিযা, সর্বোত্তম শিষ্টাচার, পরকালীন জীবন-জীনদেগী ও অবস্থার উপর ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং জান্নাতের সুখ-সামগ্রীর উপর অতীব নির্ভরযোগ্য প্রতিশ্রুতি সম্বলিত বর্ণনা বিশ্বজাতির কাছে তুলে ধরো।
২১৬৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৬৬
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهَا: أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ قَالَ: «قِرَاءَةُ الْقُرْاٰنِ فِى الصَّلَاةِ أَفْضَلُ مِنْ قِرَاءَةِ الْقُرْاٰنِ فِىْ غَيْرِ الصَّلَاةِ وَقِرَاءَةُ الْقُرْاٰنِ فِىْ غَيْرِ الصَّلَاةِ أَفْضَلُ مِنَ التَّسْبِيحِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّسْبِيحُ أَفْضَلُ مِنَ الصَّدَقَةِ وَالصَّدَقَةُ أَفْضَلُ مِنَ الصَّوْمِ وَالصَّوْمُ جُنَّةٌ مِنَ النَّارِ». رَوَاهُ الْبَيْهَقِيُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيمَانِ
আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সলাতে কুরআন পাঠ সলাতের বাইরে কুরআন পাঠের চেয়ে উত্তম। সলাতের বাইরে কুরআন পড়া, তাসবীহ ও তাকবীর পড়ার চেয়ে উত্তম। আর তাসবীহ পড়া দান করা হতে উত্তম। দান করা (নফল) সওম হতে উত্তম। আর সওম হলো জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল। (ইমাম বায়হাক্বী তাঁর শু‘আবূল ঈমান-এ বর্ণনা করেছেন)[১]
আবার সলাতের বাহিরে কুরআন তিলাওয়াত তাসবীহ-তাকবীরের চেয়ে উত্তম যদিও ঐ তাকবীর ও তাসবীহ পাঠ সলাতের ভিতরে হয়।
তাসবীহ ও তাকবীর বা অনুরূপ বিষয়গুলো দ্বারা উদ্দেশ্য যাবতীয় জিকির-আযকার। এগুলো থেকে কুরআন তিলাওয়াতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো এটি আল্লাহর কালাম। এতে রয়েছে আল্লাহর হুকুম-আহকাম, সুতরাং তা শ্রেষ্ঠ।
কেউ কেউ বলেছেন, তাসবীহ, তাকবীর, তাহমীদ, তাহলীল ইত্যাদি হলো কুরআনের ক্ষুদ্র অংশমাত্র আর তিলাওয়াত তা নয়। সুতরাং তিলাওয়াত তাসবীহ-তাহলীল থেকে শ্রেষ্ঠ। এজন্যই সলাতের মধ্যে কিয়াম রুকূ'-সাজদাহ্ ইত্যাদি থেকে বেশী ফাযীলাতপূর্ণ; আর সেটা এ বিচারে যে, কিয়ামের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াতের স্থান বা সুযোগ রয়েছে। এগুলো অনির্দিষ্ট জিকির এর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে অন্যথায় সুনির্দিষ্ট জিকির-আযকার কখনো কখনো কুরআন তিলাওয়াতের চেয়েও উত্তম যেমন ফরয সলাত আদায়ের পর হাদীসে বর্ণিত নির্ধারিত জিকির-আযকার।
জিকির-আযকার সদাকাহ্ থেকে উত্তম, এর ব্যাখ্যায় বলা হয় সকর্মক ‘ইবাদাত ‘ইবাদাতে লাযেমা বা অকর্মক ‘ইবাদাত থেকে উত্তম, কিন্তু এ হুকুম আল্লাহর জিকির বাদে অন্যান্য ‘ইবাদাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) বলেন, সদাকাহ্ দ্বারা নিসক সদাকায়ে মালী উদ্দেশ্য। আবার বলা হয়েছে সদাকাহ্ সওম থেকে উত্তম। এ সওম বলতে নফল সওম উদ্দেশ্য। তাও অবস্থাভেদে, সর্বসময়ের জন্য নয়। কেননা সওমের ব্যাপারে হাদীসে বলা হয়েছে আদম সন্তানের সকল ‘আমালের বিনিময় দশগুণে বর্ধিত করে দেয়া হয় তবে সওম ব্যতীত। আল্লাহ বলেন, কেননা সওম আমার জন্যই রাখা হয়। সুতরাং আমি নিজেই সেটার প্রতিদান প্রদান করব।
এ উত্তমতা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য। যেমন স্থান-কাল-পাত্র রয়েছে, ঠিক তেমনি ‘ইবাদাতের বিভিন্ন বিভাগও রয়েছে। যেমন কোনটি ‘ইবাদাতে বাদানী- যা দৈহিক ‘ইবাদাত (যেমন- সলাত, সিয়াম), কোনটি ‘ইবাদাতে মালী বা আর্থিক ‘ইবাদাত (যেমন- হজ, যাকাত), আবার কোনটি উভয়ের সমন্বয়ে সম্পাদিত হয়ে থাকে।
(الصَّوْمُ جُنَّةٌ) সওম হলো ঢাল, এর অর্থ হলো তা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষাকারী। অর্থাৎ- দুনিয়ার যে সমস্ত জিনিস মানুষকে আল্লাহর শাস্তি এবং ‘আযাবের দিকে নিয়ে যাবে সওম সেখানে ঢাল হিসেবে তাকে রক্ষা করবে।
২১৬৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৬৭
وَعَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ أَوْسٍ الثَّقَفِىْ عَنْ جَدِّه قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «قِرَاءَةُ الرَّجُلِ الْقُرْاٰنَ فِىْ غَيْرِ الْمَصْحَفِ أَلْفُ دَرَجَةٍ وَقِرَاءَتُه فِى الْمَصْحَفِ تُضَعَّفُ عَلٰى ذٰلِك إِلٰى أَلْفَىْ دَرَجَةٍ». رَوَاهُ الْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيمَانِ
‘উসমান ইবনু ‘আবদুল্লাহ ইবনু আওস আস্ সাকাফী (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তাঁর দাদা আওস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন ব্যক্তির মাসহাফ ছাড়া (অর্থাৎ- কুরআন দেখা ছাড়া) মুখস্থ কুরআন পড়া এক হাজার গুণ মর্যাদা সম্পন্ন। আর কুরআন মাসহাফে পড়া (অর্থাৎ- কুরআন খুলে দেখে দেখে পড়া) মুখস্থ পড়ার দু’ গুণ থেকে দু’ হাজার গুণ পর্যন্ত মর্যাদা রাখে। (বায়হাক্বী- শু‘আবূল ঈমান)[১]
২১৬৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৬৮
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمَا قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: إِنَّ هٰذِهِ الْقُلُوبَ تَصْدَأُ كَمَا يَصْدَأُ الْحَدِيدُ إِذَا أَصَابَهُ الْمَاءُ». قِيلَ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ وَمَا جِلَاؤُهَا؟ قَالَ: «كَثْرَةُ ذِكْرِ الْمَوْتِ وَتِلَاوَةِ الْقُرْاٰنِ. رَوَى الْبَيْهَقِىُّ الْأَحَادِيثَ الْأَرْبَعَةَ فِىْ شُعَبِ الْإِيمَانِ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয় হৃদয়ে মরিচা ধরে, যেভাবে পানি লাগলে লোহায় মরিচা ধরে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রসূল! এ মরিচা দূর করার উপায় কী? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করা ও কুরআন তিলাওয়াত করা। (উপরে বর্ণিত এ চারটি হাদীস ইমাম বায়হাক্বী তাঁর ‘‘শু‘আবূল ঈমান’’-এ বর্ণনা করেছেন)[১]
২১৬৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৬৯
وَعَنْ أَيْفَعَ بْنِ عَبْدٍ الْكَلَاعِىِّ قَالَ: قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ أَيُّ سُورَةِ الْقُرْاٰنِ أَعْظَمُ؟ قَالَ: ﴿قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ﴾ قَالَ: فَأَىُّ اٰيَةٍ فِى الْقُرْاٰنِ أَعْظَمُ؟ قَالَ: اٰيَةُ الْكُرْسِىِّ ﴿اللهُ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ﴾ قَالَ: فَأىُّ اٰيَةٍ يَا نَبِيَّ اللّٰهِ تُحِبُّ أَنْ تُصِيبَكَ وَأُمَّتَكَ؟ قَالَ: «خَاتِمَةُ سُورَةِ الْبَقَرَةِ فَإِنَّهَا مِنْ خَزَائِنِ رَحْمَةِ اللّٰهِ تَعَالٰى مِنْ تَحْتِ عَرْشِه أَعْطَاهَا هٰذِهِ الْأُمَّةَ لَمْ تَتْرُكْ خَيْرًا مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةِ إِلَّا اشْتَمَلَتْ عَلَيْهِ». رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ
আয়ফা' ইবনু ‘আবদিল কালা‘ঈ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, এক ব্যক্তি আরয করল, হে আল্লাহর রসূল! কুরআনের কোন্ সূরা বেশি মর্যাদাপূর্ণ? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ক্বুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ। সে আবার জিজ্ঞেস করল, কুরআনের কোন্ আয়াত বেশি মর্যাদার? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আয়াতুল কুরসী- ‘‘আল্ল-হু লা ইলা-হা ইল্লা- হুওয়াল হাইয়্যূল কইয়্যূম’’। সে পুনরায় বলল, হে আল্লাহর নাবী! কুরআনের কোন্ আয়াত এমন, যার বারাকাত আপনার ও আপনার উম্মাতের কাছে পৌঁছতে আপনি ভালবাসেন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সূরা আল বাকারাহ্’র শেষাংশ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ‘আরশের নীচের ভাণ্ডার হতে তা এ উম্মাতকে দান করেছেন। দুনিয়া ও আখিরাতের এমন কোন কল্যাণ নেই যা এতে নেই। (দারিমী)[১]
লুম্‘আত গ্রন্থকার স্বীয় গ্রন্থে বলেন, ইতিপূর্বে অতিবাহিত হয়েছে যে, আল কুরআনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সূরা হলো সূরা আল ফাতিহাহ্, এ শ্রেষ্ঠত্ব কয়েকটি দিক থেকে। (১) পবিত্র কুরআনুল কারীমের মূল উদ্দেশ্য এটাতে বিদ্যমান। (২) সলাতে সেটা পাঠ করা (সর্বসম্মতভাবে) ওয়াজীব, (কেননা সূরা আল ফাতিহাকেই সলাত বলা হয়েছে)। পক্ষান্তরে সূরা আল ইখলাস আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ বর্ণনার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ, আয়াতুল কুরসী আল্লাহ তা‘আলার চিরন্তন ও চিরস্থায়ী গুণাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ, আর সূরা আল বাকারার শেষ আয়াত দু’টি আল্লাহর নিকট দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ চাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ।
আল কুরআনের কোন্ আয়াতটি শ্রেষ্ঠ আয়াত? এ প্রশ্নের উত্তরে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ...اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ অর্থাৎ- আয়াতুল কুরসী শ্রেষ্ঠ আয়াত। লোকটি আবার যখন প্রশ্ন করলেন যে, হে আল্লাহর রসূল! আল কুরআনের কোন্ আয়াতটির কল্যাণ ও সাওয়াব আপনার জন্য এবং আপনার উম্মাতের জন্য পছন্দ করেন? এর উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সূরা আল বাকারাহ্’র শেষ আয়াত, অর্থাৎ- ...آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ থেকে শেষ পর্যন্ত। এটা আল্লাহ তা‘আলার ‘আরশে ‘আযীমের নিচে রহমাতের ভাণ্ডার থেকে উৎসারিত হয়েছে, বান্দার জন্য দুনিয়া আখিরাতের সকল কল্যাণ এতে নিহিত।
২১৭০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৭০
وَعَنْ عَبْدِ الْمَلِكِ بْنِ عُمَيْرٍ مُرْسَلًا قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «فِىْ فَاتِحَةِ الْكِتَابِ شِفَاءٌ مِنْ كُلِّ دَاءٍ». رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ وَالْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيْمَانِ
‘আবদুল মালিক ইবনু ‘উমায়র (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সূরা আল ফাতিহার মধ্যে সকল রোগের আরোগ্য রয়েছে। (দারিমী, বায়হাক্বী- শু‘আবূল ঈমান)[১]
‘আল্লামা ত্বীবী বলেনঃ কুফর, অজ্ঞতা এবং গুনাহের রোগ সহ অন্যান্য বাহ্যিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসাও এর অন্তর্ভুক্ত।
হাফেয ইবনুল কইয়্যূম আল জাওযী (রহঃ) স্বীয় ‘ত্বীববুন্ নাবী’ গ্রন্থে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় সূরা আল ফাতিহার ভূমিকা আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে বিষক্রিয়া বিনষ্টের বিষয় বিস্তারিত আলোচনা সেখানে রয়েছে। তিনি (সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত) সূরা আল ফাতিহাহ্ দিয়ে ঝাড়ফুঁক দিয়ে সাপের বিষ নামানোর হাদীস উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও সূরা আল ফাতিহাহ্ কোন পাত্রে লিখে তা ধুয়ে অসুস্থ ব্যক্তিকে পান করানো সংক্রান্ত বিস্তারিত মাসআলাহ্ সেখানে লিপিবদ্ধ রয়েছে, প্রয়োজনে উক্ত গ্রন্থ সংগ্রহ করুন এবং দেখে নিন।
২১৭১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৭১
وَعَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ قَالَ: مَنْ قَرَأَ اٰخِرَ اٰلِ عِمْرَانَ فِىْ لَيْلَةٍ كُتِبَ لَه قِيَامُ لَيْلَةٍ. رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ
‘উসমান ইবনু ‘আফফান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, যে ব্যক্তি রাতে সূরা আ-লি ‘ইমরানের শেষের অংশ পড়বে, তার জন্য সমস্ত রাত সলাতে অতিবাহিত হবার সাওয়াব লিখা হবে। (দারিমী)[১]
২১৭২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৭২
وَعَنْ مَكْحُولٍ قَالَ: مَنْ قَرَأَ سُورَةَ اٰلِ عِمْرَانَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ صَلَّتْ عَلَيْهِ الْمَلَائِكَةُ إِلَى اللَّيْلِ. رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ
মাকহূল (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
বলেছেন, যে লোক জুমার দিনে সূরা আ-লি ‘ইমরান পড়বে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) তার জন্য রাত পর্যন্ত সলাত বা দু‘আ করতে থাকবেন। (দারিমী)[১]
২১৭৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৭৩
وَعَن جُبَيْرِ بْنِ نُفَيْرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ قَالَ: «إِنَّ اللّٰهَ خَتَمَ سُورَةَ الْبَقَرَةِ بِاٰيَتَيْنِ أُعْطِيتُهُمَا مِنْ كَنْزِهِ الَّذِىْ تَحْتَ الْعَرْشِ فَتَعَلَّمُوْهُنَّ وَعَلِّمُوهُنَّ نِسَاءَكُمْ فَإِنَّهَا صَلَاةٌ وَقُرْبَانُ وَدُعَاءٌ». رَوَاهُ الدِّرَامِىُّ مُرْسَلًا
জুবায়র ইবনু নুফায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সূরা আল বাকারাকে আল্লাহ তা‘আলা এমন দু’টি আয়াত দ্বারা শেষ করেছেন, যা আমাকে আল্লাহর ‘আরশের নীচের ভাণ্ডার হতে দান করা হয়েছে। তাই তোমরা এ আয়াতগুলোকে শিখবে। তোমাদের রমণীকুলকেও শিখাবে। কারণ এ আয়াতগুলো হচ্ছে রহমত, (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের উপায়। (দীন দুনিয়ার সকল) কল্যাণলাভের দু‘আ। (মুরসালরূপে দারিমী বর্ণনা করেছেন)[১]
এ দু’টি আয়াতকে সলাত বলা হয়েছে, সলাত অর্থ এখানে ‘রহমতুন খাসসাতুন’, অর্থাৎ- বিশেষ রহমাত, অথবা রহমাতুন ‘আযীমাতুন মহা-রহমাত। কেউ কেউ এটাকে ইস্তিগফার অর্থেও ব্যবহার করেছেন। মুল্লা ‘আলী কারী এটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কেননা ইস্তিগফার অর্থ হলো ক্ষমার জন্য দু‘আ। এ দু’টি আয়াতকে আরো বলা হয়েছে (قُرْبَانٌ) কুরবা-নুন, (وَدُعَاءٌ) ওয়া দু‘আউন।
‘কুরবান’ এর অর্থ নিকটে হওয়া অথবা ما يتقرب به إلى الله تعالى অর্থাৎ- এমন জিনিস যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। কোন কোন হাদীসে قُرْبَانٌ এর স্থলে قُرْاٰنٌ শব্দ রয়েছে।
মোটকথা মুসল্লি এ দু’টি আয়াত সলাতে পাঠ করবে, আর সলাতের বাইরে কুরআন তিলাওয়াতকালে এ দু’টি আয়াত তিলাওয়াত করবে। দু‘আকারী এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দু‘আও করবে।
২১৭৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৭৪
وَعَن كَعْبٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ قَالَ: «اِقْرَؤُوْا سُوْرَةَ هُوْدٍ يَوْمَ الْجُمُعَةِ». رَوَاهُ الدِّرَامِىُّ مُرْسَلًا
কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জুমার দিনে সূরা হূদ পড়বে। (দারিমী হতে মুরসালরূপে বর্ণিত)[১]
২১৭৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৭৫
وَعَنْ أَبِىْ سَعِيدٍ أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ قَالَ: «مَنْ قَرَأَ سُوْرَةَ الْكَهْفِ فِىْ يَوْم الْجُمُعَةِ أَضَاءَ لَهُ النُّوْرُ مَا بَيْنَ الْجُمْعَتَيْنِ». رَوَاهُ الْبَيْهَقِىُّ فِى الدَّعَوَاتِ الْكَبِيْرِ
আবূ সা‘ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা আল কাহাফ পড়বে, তার (ঈমানের) নূর এ জুমাহ্ হতে আগামী জুমাহ্ পর্যন্ত চমকাতে থাকবে। (বায়হাক্বী- দা‘ওয়াতুল কাবীর)[১]
‘আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন, এক জুমাহ্ থেকে অন্য জুমাহ্ পর্যন্ত নূর বা আলোকদানের অর্থ হলো এ দীর্ঘ সময় তার কিরাআতের প্রভাব সে পাবে এবং এ এক সপ্তাহ পর্যন্ত তার সাওয়াব সে পেতে থাকবে।
২১৭৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৭৬
وَعَنْ خَالِدِ بْنِ مَعْدَانَ قَالَ: اِقْرَؤُوْا الْمُنْجِيَةِ وَهِىَ ﴿الٓمٓ تَنْزِيْلُ﴾ فَإِن بَلَغَنِىْ أَنَّ رَجُلًا كَانَ يَقْرَؤُهَا مَا يَقْرَأُ شَيْئًا غَيْرَهَا وَكَانَ كَثِيرَ الْخَطَايَا فَنَشَرَتْ جَنَاحَهَا عَلَيْهِ قَالَتْ: رَبِّ اغْفِرْ لَه فَإِنَّه كَانَ يُكْثِرُ قِرَاءَتِى فَشَفَّعَهَا الرَّبُّ تَعَالٰى فِيهِ وَقَالَ: اَكْتُبُوْا لَه بِكُلِّ خَطِيئَةٍ حَسَنَةٍ وَارْفَعُوْا لَه دَرَجَةً.
وَقَالَ أَيْضًا: «إِنَّهَا تُجَادِلُ عَنْ صَاحِبِهَا فِى الْقَبْرِ تَقُولُ: اَللّٰهُمَّ إِنْ كُنْتُ مِنْ كِتَابِكَ فَشَفِّعْنِىْ فِيهِ وَإِنْ لَمْ أَكُنْ مِنْ كِتَابِكَ فَامْحُنِىْ عَنْهُ وَإِنَّهَا تَكُونُ كَالطَّيْرِ تَجْعَلُ جَنَاحَهَا عَلَيْهِ فَتَشْفَعُ لَه فَتَمْنَعُه مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ» وَقَالَ فِىْ ﴿تَبَارَكَ﴾ مِثْلَه. وَكَانَ خَالِدٌ لَا يَبِيْتُ حَتّٰى يَقْرَأَهُمَا.
وَقَالَ طَاوُوسُ: فُضِّلَتَا عَلٰى كُلِّ سُوْرَةٍ فِى الْقُرْاٰنِ بِسِتِّينَ حَسَنَةً. رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ
খালিদ ইবনু মা‘দান (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, তোমরা মুক্তিদানকারী সূরা ‘আলিফ লাম মিম তানযীল’ (সূরা আস্ সাজদাহ্) পড়ো। কেননা নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ কথা আমার নিকট পৌঁছেছে যে, এক ব্যক্তি এ সূরা পড়ত, এছাড়া আর কোন সূরা পড়ত না। সে ছিল বড় পাপী মানুষ। এ সূরা তার ওপর ডানা মেলে বলতে থাকত, হে রব! তাকে মাফ করে দাও। কারণ সে আমাকে বেশি বেশি তিলাওয়াত করত। তাই আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যাপারে এ সূরার সুপারিশ গ্রহণ করেন ও বলে দেন যে, তার প্রত্যেক গুনাহের বদলে একটি করে নেকী লিখে নাও। তার মর্যাদা বৃদ্ধি করো।
তিনি (রাবী) আরো বলেন, এ সূরা কবরে এর পাঠকের জন্য আল্লাহর নিকট নিবেদন করবে, হে আল্লাহ! আমি যদি তোমার কিতাবের অংশ হয়ে থাকি, তুমি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। আর যদি আমি তোমার কিতাবের অংশ না হয়ে থাকি, আমাকে তোমার কিতাব হতে মুছে ফেলো। (অন্য বর্ণনায় আছে) তিনি বলেন, এ সূরা পাখীর রূপ ধারণ করে এর পাঠকারীর ওপর পাখা মেলে ধরবে ও তার জন্য সুপারিশ করবে। এর ফলে কবর ‘আযাব হতে হিফাযাত করা হবে। বর্ণনাকারী সূরা তাবা-রকাল্লাযী’ (মুল্ক) সম্পর্কেও এ একই বর্ণনা করেছেন। খালিদ এ সূরা দু’টি না পড়ে ঘুমাতেন না।
ত্বাউস (রহঃ) বলেন, এ দু’টি সূরাকে কুরআনের অন্য সব সূরা হতে ষাটগুণ অধিক নেকী অর্জনের মর্যাদা দান করা হয়েছে। (দারিমী)[১]
[২১৭৬ নং উপরোক্ত হাদীসটি মির্‘আতের মূল গ্রন্থে তিনটি আলাদা নম্বরে আনা হয়েছে]
বিশিষ্ট তাবি‘ঈ ত্বাউস বলেন, আলিফ লা-ম মীম তানযীল এবং সূরা তাবা-রকাল্লাযী-কে অন্যান্য সকল সূরা হতে ষাটগুণ মর্যাদা বেশী দান করা হয়েছে।
ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, এটা ঐ হাদীসের পরিপন্থী নয় যে, সহীহ হাদীসে সূরা আল বাকারাকে সূরা আল ফাতিহার পর কুরআনের সর্বোত্তম সূরা বলে অভিহিত করা হয়েছে। কেননা অনেক সময় তুলনামূলক কম উত্তম বস্ত্তর মধ্যেও এমন কতক গুণ ও বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় যা অধিক উত্তমের মধ্যে পাওয়া যায় না। তোমরা কি দেখো না অনেক উত্তম উত্তম সূরা থাকা সত্ত্বেও বিতর সলাতে সূরা সাব্বিহিসমা, সূরা আল কা-ফিরূন এবং সূরা আল ইখলাস পড়া উত্তম? অনুরূপ সূরা আস্ সাজদাহ্, সূরা আদ্ দাহর জুমার দিনে ফজরের সলাতে পাঠ করা অন্যান্য সূরা থেকে উত্তম?
কেউ কেউ বলেছেন ঐ দু’টি সূরা সার্বিক বিবেচনায় উত্তম নয় বরং কবরের ‘আযাব থেকে নিষ্কৃতিদানে এবং সেটা বাধাদানে অন্যান্য সকল সূরা থেকে উত্তম।
২১৭৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৭৭
وَعَنْ عَطَاءِ بْنِ أَبِىْ رَبَاحٍ قَالَ: بَلَغَنِىْ أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ قَالَ: «مَنْ قَرَأَ ﴿يٰسٓ﴾ فِىْ صَدْرِ النَّهَارِ قَضَيْتُ حَوَائِجَه» رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ مُرْسَلًا
আত্বা ইবনু আবূ রবাহ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমার কাছে এ কথা পৌঁছেছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দিনের প্রথম অংশে সূরা ইয়াসীন পড়বে, তার সব প্রয়োজন পূর্ণ হবে। (দারিমী মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করেছেন)[১]
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, ব্যক্তি দিনের শুরুতে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তার সারাদিনে যত প্রয়োজন দেখা দিবে আল্লাহ তা‘আলা তা পূর্ণ করে দিবেন।
২১৭৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৭৮
وَعَنْ مَعْقَلِ بْنِ يَسَارِ الْمُزَنِىِّ أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ قَالَ: «مَنْ قَرَأَ ﴿يٰسٓ﴾ اِبْتِغَاءَ وَجْهِ اللّٰهِ تَعَالٰى غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه فَاقْرَؤُوْهَا عِنْدَ مَوْتَاكُمْ». رَوَاهُ الْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيمَانِ
মা‘কাল ইবনু ইয়াসার আল মুযানী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে সূরা ইয়াসীন পড়বে, তার আগের গুনাহসমূহ (সগীরাহ্) মাফ করে দেয়া হবে। তাই তোমরা তোমাদের মৃত্যু (আসন্ন) ব্যক্তিদের কাছে এ সূরা পড়বে। (বায়হাক্বী- শু‘আবূল ঈমান)[১]
সূরা ইয়াসীন পাঠকারীর পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে, এ গুনাহ হলো সগীরাহ্ গুনাহ। মুল্লা ‘আলী আল কারী বলেন, আল্লাহ যাকে চাইবেন তার কাবীরাহ্ গুনাহ-ও মাফ করে দিবেন। মৃত ব্যক্তির নিকট সূরা ইয়াসীন পড়ার অর্থ হলো মৃত পথযাত্রীর নিকট পড়া অর্থাৎ- যার মৃত্যু আসন্ন হয়েছে এমন ব্যক্তির নিকট।
‘আল্লামা ত্বীবী বলেন, فاقرؤوها শব্দের মধ্যে ف বর্ণটি একটি উহ্য শর্তের জওয়াবে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ- ইখলাসের সাথে সূরা ইয়াসীন পাঠ করলে সমস্ত গুনাহ যখন মাফ হয়ে যায় সুতরাং মৃত্যুর মুখোমুখি ব্যক্তির নিকট সেটা পাঠ করো যাতে সে সেটা শুনতে পারে এবং তার অন্তরে ওটা জারি হতে পারে, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তার পূর্বের যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেন।
২১৭৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৭৯
وَعَنْ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ مَسْعُودٍ أَنَّه قَالَ: إِنَّ لِكُلِّ شَىْءٍ سَنَامًا وَإِنَّ سَنَامَ الْقُرْاٰنِ سُورَةُ الْبَقَرَةِ وَإِنَّ لِكُلِّ شَىْءٍ لُبَابًا وَإِنَّ لُبَابً الْقُرْاٰنِ الْمُفَصَّلُ. رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ
আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, প্রত্যেকটি বস্তুর একটি শীর্ষস্থান রয়েছে। কুরআনের শীর্ষস্থান হলো সূরা আল বাকারাহ্। প্রত্যেক বস্তুরই একটি ‘সার’ রয়েছে। কুরআনের সার হলো মুফাস্সাল সূরাহগুলো। (দারিমী)[১]
ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, سَنَامٌ হলো বস্ত্তর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, সূরা আল বাকারাহ্ হলো আল কুরআনের শৃঙ্গ ও শীর্ষদেশ, এতে যত আহকাম একত্রিত হয়েছে অন্য কোন সূরায় তা হয়নি। এজন্য এ সূরা মুখস্থ করার বিশেষ ফাযীলাত ও বারাকাত রয়েছে। যে বাড়ীতে সূরা আল বাকারাহ্ পাঠ করা হয় শয়তান সে বাড়ী থেকে পলায়ন করে।
অত্র হাদীসে আরো বলা হয়েছে, প্রত্যেক বস্ত্তর একটি সারনির্যাস রয়েছে, আর আল কুরআনের সার নির্যাস হলো মুফাসসাল সূরাসমূহ। এ মুফাসসাল সূরাহসমূহে যে বিষয় বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো অন্যান্য সূরায় ইজমালীভাবে এসেছে। মুফাসসাল হলো সূরা আল হুজুরা-ত থেকে সূরা আন্ নাস পর্যন্ত।
২১৮০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৮০
وَعَنْ عَلِىٍّ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ يَقُوْلُ: لِكُلِّ شَىْءٍ عَرُوْسٌ وَعَرُوْسُ الْقُرْاٰن ِالرَّحْمٰنُ. رَوَاهُ الْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيمَانِ
আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, প্রত্যেকটি জিনিসের সৌন্দর্য আছে। কুরআনের সৌন্দর্য সূরা আর্ রহমান। (ইমাম বায়হাক্বী শু‘আবূল ঈমান-এ বর্ণনা করেছেন)[১]
মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) বলেন, এ সূরায় দুনিয়া-আখিরাতের নিয়ামত এবং জান্নাতের শান্তি ও নানা আরাম-আয়েশের উপকরণের বিবরণ এখানে রয়েছে, সাথে সাথে হূরুন্‘ঈন-দের অলংকার, সাজ-সজ্জা, দেহকান্তির নানা বিবরণ এখানে রয়েছে। এতে আরো রয়েছে, জান্নাতীদের অলংকার ও রেশমের নানা মূল্যবান পোষাকের বিবরণ। সুতরাং এ দিক বিবেচনায় এ সূরাটি আল কুরআনের অলংকার ও সৌন্দর্য।
‘আল্লামা ত্বীবী বলেন, عَرُوْسٌ বলা হয় নারী-পুরুষের একান্তবাসকে। বিবাহোত্তর বাসর উদযাপনকে عَرُوْسٌ বলা হয়, যখন নারী-পুরুষ উভয়ে মূল্যবান পোষাক, দামী অলংকারে শোভিত হয়ে পরস্পরে সাক্ষাৎ লাভ করে থাকে।
২১৮১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৮১
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَنْ قَرَأَ سُورَةَ الْوَاقِعَةِ فِىْ كُلِّ لَيْلَةٍ لَمْ تُصِبْهُ فَاقَةٌ أَبَدًا». وَكَانَ ابْنُ مَسْعُودٍ يَأْمُرُ بَنَاتَه يَقْرَأْنَ بهَا فِىْ كُلِّ لَيْلَةٍ. رَوَاهُ الْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيْمَانِ
আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি প্রত্যেক রাতে ‘‘সূরা আল ওয়াকি‘আহ্’’ তিলাওয়াত করবে, সে কখনো অভাব অনটনে পড়বে না। বর্ণনাকারী ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ তাঁর কন্যাদেরকে প্রত্যেক রাতে এ সূরা তিলাওয়াত করতে বলতেন। (ইমাম বায়হাক্বী শু‘আবূল ঈমান-এ বর্ণনা করেছেন)[১]
২১৮২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৮২
وَعَنْ عَلِىٍّ قَالَ: كَانَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ يُحِبُّ هٰذِهِ السُّورَةَ ﴿سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلٰى﴾ رَوَاهُ أَحْمَدُ
আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ‘‘সাব্বিহিস্মা রব্বিকাল আ‘লা-’’ ভালবাসতেন। (আহমদ)[১]
অথবা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ সূরাটি ভালবাসার কারণ হলো এ আয়াতটিঃ إِنَّ هٰذَا لَفِى الصُّحُفِ الْأُولٰى * صُحُفِ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوسٰى এটি আহলে কিতাব ও মুশরিকদের ওপর এ কথার সাক্ষ্য দানকারী যে আল কুরআন হক বা সত্য এবং মানবমন্ডলীর জীবন পথের প্রামাণ্য দলীল।
২১৮৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৮৩
وَعَن عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: أَتٰى رَجُلٌ النَّبِىَّ ﷺ فَقَالَ أَقْرِئْنِىْ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ فَقَالَ: اقْرَأْ ثَلَاثًا مِنْ ذَوَاتِ ﴿ألر﴾ فَقَالَ: كَبُرَتْ سِنِّىْ وَاشْتَدَّ قَلْبِىْ وَغَلُظَ لِسَانِىْ قَالَ: فَاقْرَأْ ثَلَاثًا مِنْ ذَوَاتِ ﴿حٰمٓ﴾ فَقَالَ مِثْلَ مَقَالَتِه. قَالَ الرَّجُلُ: يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ أَقْرِئْنِىْ سُورَةً جَامِعَةً فَأَقْرَأَه رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ ﴿إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضِ﴾ حَتّٰى فَرَغَ مِنْهَا فَقَالَ الرَّجُلُ: وَالَّذِىْ بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَا أَزِيْدُ عَلَيْهَا أَبَدًا ثُمَّ أَدْبَرَ الرَّجُلُ فَقَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ أَفْلَحَ الرُّوَيْجِلُ» مَرَّتَيْنِ. رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُو دَاوُدَ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
বলেন, এক ব্যক্তি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে আরয করল, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে কিছু শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, আলিফ্ লা-ম রা- সম্পন্ন সূরাগুলো হতে তিনটি সূরা পড়বে। সে ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমি বুড়ো হয়ে গেছি। আমার ‘কলব’ কঠিন ও ‘জিহবা’ শক্ত হয়ে গেছে (অর্থাৎ- আমার মুখস্থ হয় না)। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তাহলে তুমি হা-মীম যুক্ত সূরাগুলোর মধ্যকার তিনটি সূরা পড়বে। আবার সে ব্যক্তি আগের জবাবের মতো জবাব দিলো। তারপর বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে আপনি পরিপূর্ণ অর্থবহ একটি সূরা শিখিয়ে দিন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাকে ‘সূরা ইযা- যুলযিলাত’ শেষ পর্যন্ত পড়িয়ে দিলেন। তখন সে ব্যক্তি বলল, যিনি আপনাকে সত্য নাবী করে পাঠিয়েছেন, তাঁর শপথ, আমি (আপনার শিখানো) সূরার উপর কখনো আর কিছু বাড়াব না। এরপর লোকটি ওখান থেকে চলে গেল। এ সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, লোকটি সফলতা লাভ করল, লোকটি সফলতা লাভ করল। (আহমদ ও আবূ দাঊদ)[১]
লোকটি তার বার্ধক্যের কথা উল্লেখ করে বললেন যে, আমার অন্তর কঠিন এবং জিহ্বা শক্ত হয়ে গেছে, এগুলো মুখস্থ করতে পারব না। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হা-মীম সম্বলিত তিনটি সূরা অর্থাৎ- যে সূরার শুরুতে হা-মীম রয়েছে তা পড়ার কথা বললেন। হা-মীম ওয়ালা সূরা মোট সাতটি, যথা- (১) সূরা গাফির (আল মু’মিন), (২) সূরা ফুসসিলাত, (৩) সূরা আশ্ শূরা-, (৪) সূরা যুখরুফ, (৫) সূরা আদ্ দুখান, (৬) সূরা আল জা-সিয়াহ্ এবং (৭) সূরা আল আহক্বা-ফ। এগুলোকেই হাদীসের ভাষায় যাওয়াতু হা-মীম বলা হয়। লোকটি পূর্বের ন্যায় আপত্তি জানালেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে একটি জামি', অর্থাৎ- ব্যাপক অর্থবোধক সূরা শিখিয়ে দিন। সুনানু আবী দাঊদ ও আহমাদ-এর বর্ণনায় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তিন মুসাব্বাহাত সূরা শিক্ষার কথা বললেন। মুসাব্বাহাত ঐ সূরাগুলোকে বলা হয় যার শুরু التسبيح-এর মাদ্দাহ বা মূল ধাতু থেকে গঠিত শব্দ দ্বারা করা হয়েছে। এটাও সাতটি সূরাতে আনা হয়েছে। লোকটি সবকিছুতেই অপারগতা প্রকাশ করলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সূরা ‘‘ইযা- যুলযিলাত’’ পড়তে বললেন। লোকটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট যেন এমন একটি বিষয় চাচ্ছিলেন যা ‘আমাল সহজ কিন্তু তার মাধ্যমেই তিনি সফলতা লাভ করতে পারেন। এজন্য তিনি বলেছিলেন আমাকে একটি ব্যাপক অর্থবোধক সূরা শিক্ষা দিন। এ সূরার মধ্যে এমন একটি অধিক অর্থ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত আয়াত আছে যার চেয়ে অধিক অর্থবোধক আয়াত অন্য কোথাও নেই। সেটি হলোঃ
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهٗ
‘‘যে ব্যক্তি এক যার্রা বা অণু পরিমাণ নেকীর কাজ করবে সে তাও দেখতে পাবে।’’ (সূরা আয্ যিলযা-ল ৯৯ : ৮)
এ অসীম বৈশিষ্ট্যের কারণে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এ সূরাটি সম্পূর্ণ পড়িয়ে শুনালেন।
লোকটি শপথ করে করে বলল, আমি কখনো এর বেশী করব না, এ শপথ ছিল তাকীদ এবং দৃঢ়তা প্রকাশার্থে যা মূলত বায়‘আত ও প্রতিশ্রুতির অর্থে ব্যবহৃত রয়েছে। ‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হলো ‘‘আমি যা শুনলাম সেটা আমার জন্য যথেষ্ট’’, এরপর আমি কিছু শুনতে পারি অথবা না পারি তাতে আমার কোন পরোয়া নেই। লোকটি চলে যেতে লাগলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মন্তব্য ‘‘লোকটি সফলকাম’’, সফলকামের অর্থ হলো কৃতকার্য হওয়া, উদ্দেশ্য হাসিল করা, কামিয়াব হওয়া।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বাক্যটি দু’বার বলেছেন, তাকীদ হিসেবে অর্থাৎ- কথাটির গুরুত্ব বুঝানোর জন্য। অথবা একবার বলেছেন, দুনিয়ার সফলতার জন্য, আরেকবার আখিরাতের সফলতা বুঝানোর জন্য।
২১৮৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৮৪
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «أَلَا يَسْتَطِيعُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَقْرَأَ أَلْفَ اٰيَةٍ فِىْ كُلِّ يَوْمٍ؟» قَالُوا: وَمَنْ يَسْتَطِيعُ أَنْ يَقْرَأَ أَلْفَ اٰيَةٍ فِىْ كُلِّ يَوْمٍ؟ قَالَ: أَمَا يَسْتَطِيعُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَقْرَأَ: ﴿أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ﴾ رَوَاهُ الْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيْمَانِ
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন বললেন, তোমাদের কেউ কি দৈনিক (কুরআনের) এক হাজার আয়াত করে পড়তে পারে? সাহাবীগণ বললেন, কে আছে দৈনিক (কুরআনের) এক হাজার আয়াত করে পড়তে পারে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন বললেন, তাহলে তোমাদের কেউ কি প্রত্যহ ‘সূরা আল হা-কুমুত্ তাকা-সুর’ পড়তে পারে না? (বায়হাক্বী- শু‘আবূল ঈমান)[১]
২১৮৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৮৫
وَعَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيَّبِ مُرْسَلًا عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ: «مَنْ قَرَأَ ﴿قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ﴾ عَشَرَ مَرَّاتٍ بُنِىَ لَه بِهَا قَصْرٌ فِى الْجَنَّةِ وَمَنْ قَرَأَ عِشْرِينَ مَرَّةً بُنِىَ لَه بِهَا قَصْرَانِ فِى الْجَنَّةِ وَمَنْ قَرَأَهَا ثَلَاثِينَ مَرَّةً بُنِىَ لَه بِهَا ثَلَاثَةُ قُصُورٍ فِى الْجَنَّةِ». فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ : وَاللّٰهِ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ إِذَا لَنُكَثِّرَنَّ قُصُورَنَا. فَقَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «اللّٰهُ أَوْسَعُ مِنْ ذٰلِكَ». رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ
সা‘ঈদ ইবনু মুসাইয়্যাব (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যদি কোন ব্যক্তি সূরা ক্বুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ’ দশবার পড়ে, বিনিময়ে তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ তৈরি করা হবে। যে ব্যক্তি বিশবার পড়বে তার জন্য দু’টি। আর যে ব্যক্তি ত্রিশবার পড়বে তার জন্য জান্নাতে তিনটি প্রাসাদ তৈরি করা হবে। এ কথা শুনে ‘উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ, হে আল্লাহর রসূল! যদি তা-ই হয় তাহলে তো আমরা অনেক প্রাসাদ লাভ করব। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর রহমত এর চেয়েও অধিক প্রশস্ত (এতে বিস্ময়ের কিছু নেই হে ‘উমার!)। (দারিমী)[১]
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, আল্লাহ আরো প্রশস্তময়, এর অর্থ হলো আল্লাহর রহমাত, কুদরত আরো প্রশস্ত। সুতরাং তোমার আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। লুম্‘আত গ্রন্থকার বলেন, ‘উমার (রাঃ)-এর উদ্দেশ্য হলো অধিক সাওয়াবের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা।
২১৮৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৮৬
وَعَنِ الْحَسَنِ مُرْسَلًا: أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ قَالَ: «مَنْ قَرَأَ فِىْ لَيْلَةٍ مِائَةَ اٰيَةٍ لَمْ يُحَاجِّهِ الْقُرْاٰنُ تِلْكَ اللَّيْلَةَ وَمَنْ قَرَأَ فِىْ لَيْلَةٍ مِائَتَيْ اٰيَةٍ كُتِبَ لَه قُنُوتُ لَيْلَةٍ وَمَنْ قَرَأَ فِىْ لَيْلَةٍ خَمْسَمِائَةً إِلَى الْأَلْفِ أَصْبَحَ وَلَه قِنْطَارٌ مِنَ الْأَجْرِ». قَالُوا: وَمَا الْقِنْطَارُ؟ قَالَ: «اِثْنَا عَشَرَ أَلْفًا». رَوَاهُ الدِّرَامِىُّ
হাসান বাসরী (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি রাতে (কুরআনের) একশ’টি আয়াত পড়বে, ওই রাতে কুরআন তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপন করবে না। আর যে ব্যক্তি রাতে দু’শত আয়াত পড়বে, তার জন্য এক রাতের ‘ইবাদাতের সাওয়াব লিখা হবে। আর যে ব্যক্তি রাতে পাঁচশ’ হতে এক হাজার আয়াত পর্যন্ত পড়বে ভোরে উঠে সে এক ‘কিনত্বার’ সাওয়াব পাবে। তারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! এক ‘কিনত্বার’ কী? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জবাব দিলেন, বারো হাজার দীনার সমান ওজন। (দারিমী)[১]
একশত আয়াত কোন রাতে তিলাওয়াত করলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে না, এর অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলা তাকে রাতে কুরআন না পড়ার অভিযোগ অথবা কম পড়ার অভিযোগে কোন শাস্তি দিবেন না এবং কুরআনের হক আদায় না করা সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করবেন না। অর্থাৎ- একশত আয়াত তিলাওয়াত করলে রাতকালীন তার ওপর কুরআন তিলাওয়াতের হক আদায় হয়ে যাবে।
কেউ কেউ বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কিয়ামুল লায়ল-এর প্রতি উৎসাহ প্রদান করা। ‘আল্লামা মুনযিরী এবং হায়সামী যথাক্রমে আত্ তারগীব এবং মাজমাউয্ যাওয়ায়িদ গ্রন্থে এ হাদীস কিয়ামুল লায়ল অধ্যায়ে এনে তার প্রমাণ দিয়েছেন।
দু’শত আয়াত পাঠ করলে তাকে রাতের ‘ইবাদাতকারী হিসেবে লেখা হবে, এর অর্থ রাতে কিয়ামুল লায়ল, কুরআন তিলাওয়াত সহ যাবতীয় নৈশ ‘ইবাদাতকারী হিসেবে লেখা হবে। সকালে সে এর সাওয়াব পাবে এক কিনত্বার পরিমাণ।
লুম্‘আত গ্রন্থকার বলেন, কিনত্বার হলো চল্লিশ উকিয়্যাহ্ স্বর্ণের সমপরিমাণ অথবা একহাজার দু’শত দীনার এর সমপরিমাণ, অথবা এক টাকশাল পরিমাণ স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য। যাই হোক উদ্দেশ্য হলো বিপুল পরিমাণ সাওয়াবের আধিক্যতা বুঝানোর জন্যই কিনত্বার শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে কিনত্বার সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, কিনত্বার হলো বারো হাজার দীনার এর সমপরিমাণ। সহীহ ইবনু হিব্বানে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে একটি মারফূ' হাদীসে আছে যে, কিনত্বার হলো বারো হাজার উকিয়্যার সমপরিমাণ।
২১৮৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৮৭
عَنْ أَبِىْ مُوسَى الْأَشْعَرِىِّ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «تَعَاهَدُوا الْقُرْاٰنَ فَوَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِه لَهْوَ أَشَدُّ تَفَصِّيًا مِنَ الْإِبِلِ فِىْ عُقُلِهَا». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আবূ মূসা আল আশ্‘আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা সবসময় কুরআনের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। যাঁর হাতে আমার জীবন নিহিত, তাঁর শপথ, নিশ্চয় কুরআন সিনা হতে এত তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায় যে, উটও তত তাড়াতাড়ি নিজের রশি ছিঁড়ে বের হয়ে যেতে পারে না। (বুখারী, মুসলিম)[১]
এ বাক্যের تَعَاهَدُ শব্দটি تعهد রূপে تفقد বা অনুসন্ধান এর অর্থ প্রদান করেছে। সুতরাং পূর্ণ বাক্যের অর্থ যেন এরূপ হয়েছে :
تفقدوه وراعوه بالمحافظة وواظبوا على قراءته وداوموا على تكرار دراسته.
অর্থাৎ- তোমরা কুরআনের প্রতি অনুসন্ধানী হও, তার হিফ্যের প্রতি যত্মবান হও, আর সদা-সর্বদা তিলাওয়াতে অভ্যস্ত হও এবং তার পাঠ-পঠন অব্যাহত রাখ, যাতে তা ভুলে না যাওয়া হয়।
‘আল্লামা তুরবিশতী (রহঃ) বলেন, عهد এবং تعاهد উভয়ের অর্থ হলো التحفظ بالشيء অর্থাৎ- কোন বস্ত্ত দ্বারা কোন বস্ত্তর হিফাযাত করা। আর تجديد العهد به এর এখানে অর্থ হলো তিলাওয়াত এবং কিরাআতের মাধ্যমে তা হিফাযাতের উপদেশ প্রদান করা যাতে স্মরণ থেকে ঐ কুরআন বিস্মৃত না হয়।
উট একটি পলায়নপর প্রাণী, একে বেঁধে না রাখলে পালিয়ে যায়। কুরআনুল কারীমকে রশিতে বাঁধা পলায়নপর উটের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ‘ইকাল বলা হয় উটের হাঁটু বাঁধার রশিকে উট যখন বসে তখন তার মোড়ানো হাঁটুকে বেঁধে রাখা হয় ফলে সে আর পালাতে পারে না। আল কুরআনের ধারক বা কুরআন পাঠকারীর অবস্থা এই যে, সে যদি কুরআনের প্রতি লক্ষ্য না রাখে, কুরআন পাঠে এবং তার হিফাযাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও যত্মশীল না হয় তাহলে ঐ পলায়নপর উটের চেয়ে অধিক দ্রুত তার হৃদয় থেকে কুরআন পালিয়ে যাবে অর্থাৎ- সে বিস্মৃত হয়ে যাবে।
কুরআনের ধারক উটের মালিকের ন্যায়, কুরআন উটের ন্যায় এবং হিফযকে উট বাঁধার (রশির) সাথে সামঞ্জস্য ও তুলনা করা হয়েছে। ‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, কুরআনুল কারীমের মাঝে এবং উটের মাঝে কোন সাদৃশ্যতা নেই। কেননা কুরআনুল কারীম হলো কদীম চিরন্তন অথচ উটনী হলো হাদেস বা নশ্বর ও ধ্বংসশীল। সুতরাং এ কুরআনুল কারীমকে উটের সাথে বাহ্যিক তুলনা করা চলে না তবে অর্থের দিক দিয়ে সামঞ্জস্য বিদ্যমান।
দৃষ্টান্ত দানের পরিপূর্ণ বিবরণ পরবর্তী হাদীসে রয়েছে। উটের স্বভাব হলো তার মালিক তার প্রতি অমোনযোগী হলেই সে সুযোগ বুঝে পলায়ন করবে। অনুরূপ কুরআনের হাফেয, সে যদি তার হিফযের প্রতি যত্মশীল না হয় বরং অমনোযোগী হয় তাহলে কুরআন তার হৃদয় স্পট থেকে ঐ উটের চেয়ে অধিক দ্রুত পলায়ন করবে।
ইবনুল বাত্ত্বাল (রহঃ) বলেন, অত্র হাদীসটি এ আয়াতদ্বয়ের অনুযায়ী, মহান আল্লাহ বলেনঃ
‘‘আমি তোমার ওপর নাযিল করছি একটি গুরুভার বাণী।’’ (সূরা আল মুযযাম্মিল ৭৩ : ৫)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা আরো বলেনঃ ‘‘আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি, এ থেকে উপদেশ গ্রহণের কেউ আছ কি?’’ (সূরা আল কামার ৫৪ : ১৭)
যে কুরআন হিফাযাতে এগিয়ে আসবে, তাতে যত্মবান ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে কুরআন তার হিফয বা মুখস্থকরণে তাকে সহযোগিতা করা হবে। পক্ষান্তরে যে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে এবং পলায়ন করবে কুরআনও তার নিকট থেকে পালিয়ে যাবে, অর্থাৎ- সে কুরআন বিস্মৃত হয়ে যাবে।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেনঃ আল কুরআন মানুষের কোন কথা বা বাণী নয়, বরং মহান শক্তি ও ক্ষমতাধর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বাণী, এতদ্বয়ের কথার মধ্যে কোন নিকটতম মুনাসিবাত বা সম্পর্ক নেই। কেননা কালামে বাশার হলো হাদেস এবং কালামুল্লাহ হলো কদীম বা চিরন্তন, কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়াতা‘আলা তাঁর ব্যাপক অনুগ্রহ ও চিরন্তন দয়া দ্বারা মানুষের ওপর অনুগ্রহ করে কুরআন মুখস্থ বা হিফয করার বিশাল নিয়ামত দান করেছেন।
সুতরাং বান্দার জন্য উচিত সাধ্যমত কুরআন হিফয বা মুখস্থ করার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলার সে নিয়ামতের প্রতি যত্মবান ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া। তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য কুরআনকে সহজ করে দিবেন। অন্যথায় মানবীয় শক্তি ও যোগ্যতা তা হিফয করতে সত্যই অপারগ।
[আপনি কি পৃথিবীর কোন ধর্ম গ্রন্থের একজন হাফেযও খুঁজে পাবেন? না, পাবেন না, তবে হ্যাঁ, পাবেন কুরআনুল কারীমের, তা একজন দু’জন নয় বরং কোটি কোটি হাফিযে কুরআন, আপনার সামনেই!! তবুও কি এ চিরন্তন কিতাব আপনি বিশ্বাস করবেন না?] -অনুবাদক
২১৮৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৮৮
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «بِئْسَ مَالِأَحَدِهِمْ أَنْ يَقُولَ: نَسِيتُ اٰيَةَ كَيْتَ وَكَيْتَ بَلْ نُسِّىَ وَاسْتَذْكِرُوا الْقُرْاٰنَ فَإِنَّه أَشَدُّ تَفَصِّيًا مِنْ صُدُورِ الرِّجَالِ مِنَ النَّعَمِ». مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ. وَزَادَ مُسْلِمٌ: بِعُقُلِهَا
আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন ব্যক্তির জন্য এ কথা বলা খুবই খারাপ যে, আমি কুরআনের অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি। বরং সে যেন বলে, তাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা বার বার কুরআন পড়তে থাকবে। কারণ কুরআন মানুষের মন হতে চতুষ্পদ জন্তু হতেও দ্রুত পালিয়ে যায়। (বুখারী, মুসলিম। ইমাম মুসলিম, ‘রশিতে বাঁধা চার পা জন্তু’ বাড়িয়ে বলেছেন।)[১]
ইবনু হাজার (রহঃ) তাঁর ফাতহুল বারী গ্রন্থে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এখানে الذم (দোষারোপ)-এর কারণ বলতে কুরআনের প্রতি অমনোযোগিতাকে বুঝা যায়। কেননা এর প্রতি যত্নবান না হওয়া ও অধিক অবহেলার কারণে ভুল হয়ে থাকে। তাই যদি সে তিলাওয়াত ও সলাতে বেশি বেশি পড়ার মাধ্যমে কুরআনের প্রতি মনোযোগী হয় তাহলে তার হিফয স্থায়ী থাকবে।
কাযী ‘ইয়ায বলেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করল। অতঃপর গাফেল হয়ে ভুলে গেলে তার অবস্থা নিন্দনীয়। অর্থাৎ- এখানে (ذم الحال) নিন্দনীয় অবস্থা উদ্দেশ্য, (ذم القول) নিন্দনীয় কথা নয়।
২১৮৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৮৯
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ قَالَ: إِنَّمَا مَثَلُ صَاحِبِ الْقُرْاٰنِ كَمَثَلِ صَاحِبِ الْإِبِلِ الْمُعَقَّلَةِ إِنْ عَاهَدَ عَلَيْهَا أَمْسَكَهَا وَإِنْ أَطْلَقَهَا ذَهَبَتْ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআনকে স্মৃতিতে ধারণকারীদের দৃষ্টান্ত হলো রশিতে বাঁধা উটের মতো। উটের প্রতি সব সময় লক্ষ্য রেখেই তাঁকে বেঁধে রাখা যেতে পারে। আর লক্ষ্য না রাখলে সে রশি ছিঁড়ে পালিয়ে যায়। (বুখারী ও মুসলিম)[১]
২১৯০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৯০
وَعَنْ جُنْدُبِ بْنِ عَبْدُ اللّٰهِ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «اِقْرَؤُوا الْقُرْاٰنَ مَا ائْتَلَفَتْ عَلَيْهِ قُلُوبُكُمْ فَإِذَا اخْتَلَفْتُمْ فَقُوْمُوْا عَنهُ». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
জুনদুব ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মনের আকর্ষণ থাকা পর্যন্ত কুরআন পড়বে। মনের ভাব পরিবর্তিত হলে অর্থাৎ- আগ্রহ কমে গেলে তা ছেড়ে উঠে যাবে। (বুখারী, মুসলিম)[১]
২১৯১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৯১
وَعَنْ قَتَادَةَ قَالَ: سُئِلَ أَنَسٌ: كَيْفَ كَانَتْ قِرَاءَةُ النَّبِىِّ ﷺ فَقَالَ: كَانَتْ مَدًّا مَدًّا ثُمَّ قَرَأَ: بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ يَمُدُّ بِبَسْمِ اللّٰهِ وَيَمُدُّ بِالرَّحْمٰنِ وَيَمُدُّ بِالرَّحِيمِ. رَوَاهُ البُخَارِىُّ
আবূ কাতাদাহ্ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একবার আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরআন পাঠ কেমন ছিল? তিনি বললেন, তাঁর কুরআন পাঠ ছিল টানা টানা। তারপর তিনি [আনাস (রাঃ)] ‘বিস্মিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ পড়লেন। তিনি ‘বিস্মিল্লা-হি’ টানলেন। ‘রহমা-নির’ টানলেন এবং ‘রহীম’-এ টানলেন। (বুখারী)[১]
২১৯২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৯২
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَا أَذِنَ اللّٰهُ لِشَىْءٍ مَا أَذِنَ لِنَبِىِّ يَتَغَنّٰى بِالْقُرْاٰنِ». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একজন নাবীর সুর করে কুরআন পড়াকে আল্লাহ তা‘আলা যতটা কান পেতে শোনেন আর কোন কথাকে এতো কান পেতে শোনেন না। (বুখারী, মুসলিম)[১]
২১৯৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৯৩
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَا أَذِنَ اللّٰهُ لِشَىْءٍ مَا أَذِنَ لِنَبِىِّ حَسِنِ الصَّوْتِ بِالْقُرْاٰنِ يَجْهَرُ بِه». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা কোন নাবীর মধুর স্বরে সুরেলা কণ্ঠে স্বরবে কুরআন পাঠ যত পছন্দ করেন, তত পছন্দ করেন না আর কোন স্বরকে। (বুখারী, মুসলিম)[১]
২১৯৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৯৪
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْاٰنِ». رَوَاهُ البُخَارِىُّ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সুর করে কুরআন পড়ে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (বুখারী)[১]
কেউ বলেন, (لم يحسن صوته) অর্থাৎ- যে সুন্দর কন্ঠে পড়ে না।
কেউ বলেন, (لم يجهر به) অর্থাৎ- যে উঁচু স্বরে পড়ে না।
কেউ বলেন, (لم يستغن به عن الناس) অর্থাৎ যে মানুষের কাছ থেকে এবং পূববর্তীদের ঘটনা প্রবাহ ও কিতাবাদি থেকে অমুখাপেক্ষী হতে চায় না।
কেউ বলেন, (لم يترنم) অর্থাৎ- যে ব্যথিত চিন্তিত হয় না।
কেউ বলেন, (التلذذ والاستحلاء) অর্থাৎ যে মজা পায় না বা স্বাদ পায় না।
কেউ বলেন, (أن يجعله هجيراه) অর্থাৎ- দুপুরে তিলাওয়াত করে না।
কেউ বলেন, যে ঈমানের জন্য কুরআন থেকে উপকার গ্রহণ করে না এবং তার মধ্যস্থিত প্রতিশ্রুতি ও শাস্তির কথাকে সত্য বলে স্বীকার করে না।
(لم يطلب غنى النفس) অর্থাৎ- যে স্বীয় আত্মপ্রফুল্লতা চায় না।
ইমাম ইবনু হাজার (রহঃ) উপরোক্ত ব্যাখ্যাসমূহের সমন্বয় সাধন করে বলেন যে, সুমধুর সুরে উচ্চৈঃস্বরে চিন্তাবিমোহিত হয়ে ও নিজকে সংবাদ সম্পর্কে অন্যের নিকট অমুখাপেক্ষী মনে করে কুরআন পাঠ করে। কেননা সুললিত কন্ঠের পাঠ দ্বারা অন্তর বিমুগ্ধ হয় অন্তর বিগলিত হয়ে অশ্রু বয়ে যায়।
২১৯৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৯৫
وَعَنْ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ لِي رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَرِ: «اقْرَأْ عَلَىَّ». قُلْتُ: أَقْرَأُ عَلَيْكَ وَعَلَيْكَ أُنْزِلَ؟ قَالَ: «إِنِّىْ أُحِبُّ أَنْ أَسْمَعَهُ مِنْ غَيْرِىْ». فَقَرَأْتُ سُورَةَ النِّسَاءِ حَتَّى اتَيْتُ إِلٰى هٰذِهِ الْاٰيَةِ (فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلٰى هَؤُلَاءِ شَهِيْدًا) قَالَ: «حَسْبُكَ الْاٰنَ». فَالْتَفَتُّ إِلَيْهِ فَإِذَا عَيْنَاهُ تَذْرِفَانِ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বারে বসে আমাকে বললেন, তুমি আমার সামনে কুরআন পড়ো (আমি তোমার কুরআন পড়া শুনব)। (তাঁর কথা শুনে) আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনার সামনে আমি কুরআন পড়ব? অথচ এ কুরআন আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ কুরআন আমি অন্যের মুখে শুনতে পছন্দ করি। অতঃপর আমি সূরা আন্ নিসা পড়তে শুরু করলাম। আমি ‘‘তখন কেমন হবে আমি যখন প্রত্যেক উম্মাতের বিরুদ্ধে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং আপনাকেও সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করব এদের বিরুদ্ধে’’ এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এখন বন্ধ করো। এ সময় আমি তাঁর দিকে তাকালাম। দেখলাম তাঁর দু’ চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। (বুখারী, মুসলিম)[১]
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, কুরআন পাঠের সময় ক্রন্দন করা সৎ মানুষের গুণ। ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেন, কেউ কুরআন পাঠের সময়ে কাঁদতে চাইলে মনকে চিন্তিত করতে হবে এবং তার মধ্যে বর্ণিত শাস্তি, ধমক, হুমকি, প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে ভয় করতে হবে। তারপর সে স্বীয় অভ্যন্তরে সেগুলোর কমতি বুঝতে পারবে। এরূপ হলে তার কান্না আসবে।
২১৯৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৯৬
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ لِأُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ: «إِنَّ اللّٰهَ أَمَرَنِىْ أَنْ أَقْرَأَ عَلَيْكَ الْقُرْاٰنَ» قَالَ: اللّٰهُ سَمَّانِىْ لَكَ؟ قَالَ: «نَعَمْ». قَالَ: وَقَدْ ذُكِرْتُ عِنْدَ رَبِّ الْعَالَمِينَ؟ قَالَ: «نَعَمْ». فَذَرَفَتْ عَيْنَاهُ. وَفِىْ رِوَايَةٍ: إِنَّ اللّٰهَ أَمَرَنِىْ أَنْ أَقْرَأَ عَلَيْكَ ﴿لَمْ يَكُنِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا﴾ قَالَ: وَسَمَّانِىْ؟ قَالَ: «نَعَمْ». فَبَكٰى. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-কে বললেন, তোমাকে কুরআন তিলাওয়াত শুনাতে আল্লাহ আমাকে হুকুম দিয়েছেন। উবাই জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহ কি আমার নাম ধরে আপনাকে এ কথা বলেছেন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। এবার উবাই বললেন, রব্বুল ‘আলামীনের কাছে আমি কী উত্থাপিত হয়েছি? রব্বুল ‘আলামীনের কাছে আমার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে? বা আমার নাম নেয়া হয়েছে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ। এ কথা শুনে উবাই-এর দু’ চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। অন্য এক বর্ণনায় আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ ‘‘আমাকে আল্লাহ তা‘আলা হুকুম দিয়েছেন তোমাকে ‘লাম ইয়াকুনিল্লাযীনা কাফারূ’ সূরা পাঠ শুনাতে। উবাই বললেন, আল্লাহ কি আমার নাম বলেছেন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। শুনে উবাই কেঁদে ফেললেন। (বুখারী, মুসলিম)[১]
২১৯৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৯৭
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: نَهٰى رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ إِن يُسَافَرَ بِالْقُرْاٰنِ إِلٰى أَرْضِ الْعَدُوِّ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ. وَفِىْ رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ: «لَا تُسَافِرُوا بِالْقُرْاٰنِ فَإِنِّىْ لَا اٰمَنُ أَن يَنَالهُ الْعَدُوُّ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুর দেশে কুরআন নিয়ে সফর করতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী, মুসলিম। ইমাম মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, কুরআন নিয়ে সফরে বের হয়ো না। কারণ কুরআন শত্রুর হাতে পড়ে যাওয়া আমি নিরাপদবোধ করি না।)[১]
২১৯৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৯৮
عَنْ أبىِىْ سَعِيْدِ الْخُدْرِىِّ قَالَ: جَلَسْتُ فِىْ عِصَابَةٍ مِنْ ضُعَفَاءِ الْمُهَاجِرِينَ وَإِنَّ بَعْضَهُمْ لِيَسْتَتِرُ بِبَعْضٍ مِنَ الْعُرْى وَقَارِئٌ يَقْرَأُ عَلَيْنَا إِذْ جَاءَ رَسُولِ اللّٰهِ ﷺ فَقَامَ عَلَيْنَا فَلَمَّا قَامَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ سَكَتَ الْقَارِئُ فَسَلَّمَ ثُمَّ قَالَ: «مَا كُنْتُمْ تَصْنَعُونَ؟» قُلْنَا: كُنَّا نَسْتَمِعُ إِلٰى كِتَابِ اللهِ قَالَ فَقَالَ: «الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِىْ جَعَلَ مِنْ أُمَّتِىْ مَنْ أُمِرْتُ أَنْ أَصْبِرَ نَفْسِىْ مَعَهُمْ». قَالَ فَجَلَسَ وَسَطَنَا لِيَعْدِلَ بِنَفْسِه فِينَا ثُمَّ قَالَ بِيَدِه هَكَذَا فَتَحَلَّقُوا وَبَرَزَتْ وُجُوهُهُمْ لَه فَقَالَ: «أَبْشِرُوا يَا مَعْشَرَ صَعَالِيكِ الْمُهَاجِرِينَ بِالنُّورِ التَّامِّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ قَبْلَ أَغْنِيَاءِ النَّاسِ بِنِصْفِ يَوْمٍ وَذٰلِكَ خَمْسمِائَةِ سَنَةٍ». رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ
আবূ সা‘ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি একবার দরিদ্র মুহাজিরদের একদলের মধ্যে বসলাম। তারা নিজেদের পোশাক স্বল্পতার জন্য একে অন্যের সাথে মিশে মিশে বসেছিলেন। এ সময় একজন আমাদের সামনে কুরআন পাঠ করছিল। এ সময় হঠাৎ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে দাঁড়ালে কুরআন পাঠক চুপ হয়ে গেল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন আমাদেরকে সালাম দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী করছিলে তোমরা? জবাবে আমরা বললাম, আল্লাহর কিতাব শুনছিলাম। এ কথা শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তা‘আলার শুকর, যিনি আমার উম্মাতের মধ্যে এ ধরনের লোক সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যাদের সাথে শারীক হবার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি।
বর্ণনাকারী আবূ সা‘ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) বলেন, এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের মধ্যে বসে নিজেকে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর হাত দিয়ে (ইশারা করে) বললেন, তোমরা গোল হয়ে বসো। (বর্ণনাকারী বলেন এ কথা শুনে) তারা গোল হয়ে বসলেন। তাদের চেহারা রসূলের মুখোমুখি হয়ে গেল। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে গরীব মুহাজিরের দল! তোমরা কিয়ামাতের দিন পূর্ণ জ্যোতির সুখবর গ্রহণ কর। তোমরা ধনীদের অর্ধেক দিন পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর এ অর্ধেক দিনের (পরিমাণ) হলো পাঁচশ বছর। (আবূ দাঊদ)[১]
২১৯৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২১৯৯
وَعَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «زَيِّنُوا الْقُرْاٰنَ بِأَصْوَاتِكُمْ». رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُو دَاوُدَ وَابْنُ مَاجَهْ وَالدَّارِمِىُّ
বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘তোমাদের মিষ্টি স্বর দিয়ে কুরআনকে সুন্দর করো।’ (আহমদ, আবূ দাঊদ, ইবনু মাজাহ ও দারিমী)[১]
২২০০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২০০
وَعَنْ سَعْدِ بْنِ عُبَادَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَا من امْرِئٍ يَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ ثُمَّ يَنْسَاهُ إِلَّا لَقِىَ اللّٰهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَجْذَمَ». رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ والدَّارِمِىُّ
সা‘দ ইবনু ‘উবাদাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন শিখে ভুলে গিয়েছে, সে কিয়ামাতের দিন অঙ্গহানি অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে। (আবূ দাঊদ, দারিমী)[১]
হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী বলেন, কুরআন ভোলা ব্যক্তির পাপের ব্যাপারে সালাফে সলিহীনের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেন কাবীরাহ্ গুনাহ হবে, কেউ বলেন পাপ হবে, যেমন মাওকূফ সূত্রে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, (ما من أحد تعلم القرآن ثم نسيه إلا بذنب)। আবূ ‘উবাদাহ্ الضحاك بن مزاحم সূত্রে বলেন, কুরআন ভোলা বড় বিপদ বা গুনাহ। কেননা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, عرضت على ذنوب أمتي فلم أر ذنباً أعظم من سورة القرآن أويتها رجل ثم نسيها (হাদীসটির সানাদ য‘ঈফ)। সাহাবী আবূ ‘আলিয়্যাহ্ বলেন, كنا نعد من أعظم الذنوب أن يتعلم الرجل القرآن ثم ينام عنه حتى ينساه অর্থাৎ- আমরা সবচাইতে বড় পাপ বলে আখ্যায়িত করতাম কোন ব্যক্তির কুরআন শিক্ষা গ্রহণের পর অবহেলাবশত তা ভুলে গেলে। কুরআন তিলাওয়াত বিমুখতা ভুলে যাবার কারণ। আর ভুলে যাওয়া তার যত্নহীনতা ও তুচ্ছজ্ঞান প্রমাণ করে।
২২০১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২০১
وَعَنْ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ قَالَ: «لَمْ يَفْقَهْ مَنْ قَرَأَ الْقُرْاٰنَ فِى اَقَلِّ مِنْ ثَلَاثٍ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَأَبُو دَاوُدَ والدَّارِمِىُّ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তিন দিনের কমে কুরআন পড়েছে, সে কুরআন বুঝেনি। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ, দারিমী)[১]
‘আবদুল্লাহ বিন মাস্‘ঊদ বলেন, তোমরা তিন দিনের কমে কুরআন পড়ে শেষ করো না।
ইমাম ত্ববারানী (রহঃ) তাঁর ‘আল কাবীর’ গ্রন্থে বলেন, তোমরা তিন দিনের কমে কুরআন পড়ো না, বরং সাত দিনে খতম কর।
সালাফগণ এ নিয়ে মতানৈক্য করেছেন তাদের অনেকে তিন দিনের কমে পড়াকে মাকরূহ বলেছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ, ইসহাক বিন রহ্ওয়াইহি, আবূ ‘উবায়দ প্রমুখ। কোন জাহিরী মতাবলম্বী এটাকে হারাম বলেছেন, তবে কোন বিদ্বান এটার রুখসাত দিয়েছেন তারা দলীল হিসেবে ‘উসমান-এর হাদীস যথাঃ (إنه كان يقرأ القرآن في ركعة يوتر بها) এবং সা‘ঈদ বিন জুবায়র-এর হাদীস যথা (أنه قرأ القرآن في ركعة في الكعبة) উল্লেখ করেন।
হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) আহমাদ, ইসহাক-এর মতটি গ্রহণ করে ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার-এর হাদীস পেশ করেন।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, অধিকাংশ ‘আলিমের অভিমত হলো যে, এর কোন নির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। এটা পাঠকের উৎসাহ, আগ্রহ, চাহিদা, শক্তির উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি বিশেষ অবস্থার কারণে পড়ার সময় বিভিন্ন রকম হতে পারে। সুতরাং যেই ব্যক্তির দ্রুত পড়ার সাথে সাথে আয়াতের ভাবার্থ, তাৎপর্য, মাহাত্ম্য পূর্ণরূপে বুঝতে পারবে সে তাড়াতাড়ি পড়বে। আর এর ব্যতিক্রম হলে সে ধীরে ধীরে পড়বে। মির্‘আতুল মাফাতীহ গ্রন্থকার বলেন, আমার নিকটে আহমাদ, ইসহাক-এর মতটি পছন্দনীয়। কেননা ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার ও ‘আয়িশাহ্ এর হাদীস সর্বাধিক অনুসরণযোগ্য।
২২০২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২০২
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «الْجَاهِرُ بِالْقُرْاٰنِ كَالْجَاهِرِ بِالصَّدَقَةِ وَالْمُسِرُّ بِالْقُرْاٰنِ كَالْمُسِرِّ بِالصَّدَقَةِ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِىُّ وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ: هٰذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ
উকবাহ্ ইবনু ‘আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ উচ্চৈঃস্বরে কুরআন পড়া প্রকাশ্যে সদকা করার মতো। আর চুপে চুপে কুরআন পড়া চুপে চুপে সদকা করার মতো। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও নাসায়ী। ইমাম তিরমিযী বলেন, এ হাদীসটি হাসান ও গরীব।)[১]
উভয়ের মাঝে সমাধানকল্পে ইমাম তিরমিযী বলেন,
(إن الأسرار أبعد من الرياء فهو أفضل في حق من يخاف ذلك، فإن لم يخف الرياء فالجهر أفضل بشرط أن لا يؤذي غيره)
অর্থাৎ- নীরবে পড়া রিয়া বা লৌকিকতা থেকে অধিক দূরের বিষয়। আর যার রিয়ার আশংকা আছে তার জন্য নীরবে পড়া উত্তম। কিন্তু যার এই ভয় নেই তার উঁচু স্বরে পড়া বেশি ভাল, তবে এর দ্বারা মুসল্লি, ঘুমন্ত ব্যক্তির যেন কষ্ট না হয়। অর্থাৎ- যেখানে লৌকিকতা, মুসল্লির কষ্টের সম্ভাবনা রয়েছে সেথায় নীরবে পড়া উত্তম। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বরবে পড়া উত্তম। এর প্রতি ‘আমাল করা উল্লেখযোগ্য কাজ। কেননা এর মাধ্যমে মানুষ মনোযোগ সহকারে শোনার, শিক্ষার, অনুসরণ করার উপকার পায়। উপরন্তু এটি একটি ধর্মের প্রতীক। আর এর দ্বারা পাঠকের কলব জাগ্রত হয়, তার চেতনা চিন্তার জন্য পুঞ্জীভূত হয় কেননা এটা ঘুমকে দূরীভূত করে। এসব নিয়্যাতে উঁচু স্বরে কুরআন পড়া উত্তম কাজ।
২২০৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২০৩
وَعَنْ صُهَيْبٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَا اٰمَنَ بِالْقُرْاٰنِ مَنِ اسْتَحَلَّ مَحَارِمَه». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَقَالَ: هٰذَا حَدِيثٌ لَيْسَ إِسْنَادُه بِالْقَوِىِّ
সুহায়ব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক কুরআনে বর্ণিত হারামকে হালাল মনে করেছে সে কুরআনের উপর ঈমান আনেনি। (তিরমিযী; তিনি বলেছেন, এ হাদীসের সানাদ দুর্বল।)[১]
২২০৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২০৪
وَعَنِ اللَّيْثِ بْنِ سَعْدٍ عَنِ ابْنِ أَبِىْ مُلَيْكَةَ عَنْ يَعْلَى بْنِ مُمَلَّكٍ أَنَّه سَأَلَ أُمَّ سَلَمَةَ عَنْ قِرَاءَةِ النَّبِىِّ ﷺ فَإِذَا هِىَ تَنْعَتُ قِرَاءَةً مُفَسَّرَةً حَرْفًا حَرْفًا. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِىُّ
লায়স ইবনু সা‘দ (রহঃ) ইবনু আবূ মুলায়কাহ্ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি ইয়া‘লা ইবনু মুমাল্লাক (রহঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, ইয়া‘লা একদিন উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামাহ্ (রাঃ)-কে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরআন পাঠ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। উম্মু সালামাহ্ (রাঃ)-কে শুনাতে দেখা গেল, রসূলের কুরআন পাঠ অক্ষর অক্ষর পৃথক করে প্রকাশ করছেন। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ, নাসায়ী)[১]
ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, অতিরিক্ত তাড়াতাড়ি করে কুরআন পড়া মাকরূহ মর্মে ‘আলিমদের ঐকমত্য হয়েছে। তারা বলেন, বিনা তারতীলে দুই জুয বা পারা কুরআন পড়ার চাইতে ঐ সময়ে তারতীলসহ স্পষ্টভাবে একপারা পড়া বেশি উত্তম। আর কুরআন অনুধাবন করার জন্য তারতীলসহ কুরআন পড়া মুস্তাহাব। কারণ এটা কুরআনের মাহাত্ম্য বর্ণনা ও সম্মানের নিকটতম পন্থা এবং অন্তরে বেশি ক্রিয়াশীল। এজন্য অনারবী ব্যক্তির জন্য স্পষ্টভাবে তারতীলসহ কুরআন পড়া মুস্তাহাব। আল জাযরী (রহঃ) তাঁর النشر ‘আন্ নাশর’ গ্রন্থে বলেন, তারতীলসহ কুরআন পড়া মর্যাদার দিক থেকে অধিকতর সম্মানিত। আর সাওয়াব বেশি হয় সংখ্যায় বেশি তিলাওয়াত করলে। কারণ একটি হরফে দশটি নেকি হয়।
২২০৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২০৫
وَعَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ عَنِ ابْنِ أَبِىْ مُلَيْكَةَ عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ: كَانَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ يُقَطِّعُ قِرَاءَتَه يَقُولُ: الْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ثُمَّ يَقِفُ ثُمَّ يَقُولُ: الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ثُمَّ يَقِفُ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَقَالَ: لَيْسَ إِسْنَادُه بِمُتَّصِلٍ لِأَنَّ اللَّيْثَ رَوٰى هٰذَا الْحَدِيثَ عَنِ ابْنِ أَبِىْ مُلَيْكَةَ عَنْ يَعْلَى بْنِ مَمْلَكٍ عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ وَحَدِيثُ اللَّيْثِ أَصَحُّ
ইবনু জুরায়জ (রহঃ) ইবনু আবূ মুলায়কাহ্ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) বলেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাক্যের মধ্যে পূর্ণ থেমে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তিনি বলতেন, ‘আলহাম্দু লিল্লা-হি রব্বিল ‘আ-লামীন’, এরপর থামতেন। তারপর বলতেন, ‘আর্ রহমা-নির রহীম’, তারপর বিরতি দিতেন। (তিরমিযী। তিনি বলেছেন, এ হাদীসের সানাদ মুত্তাসিল নয়। কারণ আগের হাদীসে লায়স একে ইবনু আবূ মুলায়কাহ্ হতে এবং তিনি ইয়া‘লা ইবনু মামলাক হতে আর ইয়া‘লা উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। [অথচ এখানে ইয়া‘লা-এর উল্লেখ নেই] তাই উপরের লায়স-এর বর্ণনাটি অধিক নির্ভরযোগ্য।)[১]
কারীদের পরিভাষায় وقف হলো কিছু সময়ের জন্য শব্দ উচ্চারণ করা থেকে আওয়াজ বন্ধ করা যাতে স্বাভাবিকভাবে কিরাআত শুরু করার উদ্দেশে শ্বাস গ্রহণ করতে পারে। কিরাআত হতে বিমুখ হওয়ার উদ্দেশে নয়। আর এটা আয়াতের শেষে অথবা মাঝে হবে। কিন্তু এটা শব্দের মধ্যে এবং যা কোন রীতি সম্বলিত তাতে নয়।
কারীগণ কিরাআত শুরু ও শেষ করার প্রকারভেদ নিয়ে বিভিন্ন রকম মতভেদ প্রকাশ করেছন, ইবনুল আনবারী (রহঃ) বলেন, ওয়াকফ তিন ধরনেরঃ
১. تام (পরিপূর্ণ) ২. حسن (ভাল) ৩. قبيح (মন্দ)
আবার কেউ বলেন, ওয়াকফ চার প্রকার-
1. قبيح متروك 2. تام مختار 3. كاف جائز 4. حسن مفهوم
ইবনু জাযরী (রহঃ) বলেন, ওয়াকফ এর প্রকারভেদের নির্দিষ্ট কোন সীমা বা নিয়ম-নীতি নেই। তবে তিনি এগুলোর পর্যালোচনা করে মোটামুটি একটি নিয়ম বলেছেন তা হলো যদি ওয়াকফের পরবর্তী বাক্যের সাথে এর শাব্দিক কোন সম্পর্ক থাকে অর্থগত নয় তবে এটাকে حسن বলা হয়।
জমহূর কারীর মতানুযায়ী যে সব আয়াতের শেষের সাথে পরের অংশের সম্পর্ক রয়েছে সে ক্ষেত্রে মিলিয়ে পড়া উত্তম।
ইবনুল জাযরী (রহঃ) বলেন, আয়াতকে আলাদা করার উদ্দেশ্য প্রতিটি আয়াতের শেষে থামা মুস্তাহাব। আবার কেউ বলেছেন, এটা সুন্নাত।
ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) তাঁর الشعب গ্রন্থে এবং ইমাম ইবনুল কইয়্যিম (রহঃ) তাঁর زاد المعاد (যাদুল মা‘আদ) গ্রন্থে বলেছেনঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথ ও সুন্নাতের সর্বাধিক অনুসরণের নিয়ম হচ্ছে প্রতিটি আয়াতের শেষে থেমে যাওয়া যদিও এর পরবর্তী অংশের সাথে এর সম্পর্ক থাকে। ইবনুল কইয়্যিম (রহঃ) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি আয়াতের শেষে ওয়াকফ করতেন।
‘আল্লামা যুহরী (রহঃ) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিরাআত আয়াত-আয়াত করে পড়তেন। আর এটাই সর্বোত্তম ওয়াক্ব্ফের স্থান যদিও পরবর্তী আয়াতের সাথে সম্পর্ক রয়েছে।
‘আল্লামা শায়খ ‘আবদুল হক দেহলভী (রহঃ) তাঁর أشعة اللمعات গ্রন্থে বলেন, এ ধরনের আয়াতকে মিলিয়ে পড়া অগ্রাধিকারযোগ্য মত। তবে আয়াতের শেষে থেমে যাওয়া ও আয়াতের প্রথম থেকে শুরু করা সুন্নাত।
২২০৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২০৬
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ وَنَحْنُ نَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ وَفينَا الْأَعرَابِىُّ وَلْأَعَجَمِىُّ قَالَ: «اِقْرَؤُوا فَكُلٌّ حَسَنٌ وَسَيَجِىْءُ أَقْوَامٌ يُقِيمُونَه كَمَا يُقَامُ الْقِدْحُ يَتَعَجَّلُونَه وَلَا يَتَأَجَّلُونَه». رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَالْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيمَانِ
জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এলেন। আমরা তখন কুরআন তিলাওয়াত করছিলাম। এ পাঠের মধ্যে ‘আরব অনারব সবই ছিল (যারা কুরআন পাঠে ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারছিল না) তারপরও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ পড়ে যাও। প্রত্যেকেই ভাল পড়ছো। (মনে রাখবে) অচিরেই এমন কতক দল আসবে যারা ঠিক মতো কুরআন পাঠ করবে, যেভাবে তীর সোজা রাখা হয়। তারা (দুনিয়াতেই) তাড়াতাড়ি এর ফল চাইবে। আখিরাতের জন্য অপেক্ষা করবে না। (আবূ দাঊদ, বায়হাক্বী- শু‘আবূল ঈমান)[১]
العجمى বলা হয়, যারা ‘আরব অঞ্চলের বাহিরে রোম, পারস্যে, হাবশায় বসবাস করে। যেমন সালমান, শু‘আয়ব, বিলাল (রাঃ) প্রমুখ أعرابى হোক বা عجمى হোক সবার তিলাওয়াত সুন্দর ও প্রত্যাশিত এবং এটা সাওয়াব এর ফল। যদিও উভয়ের মাঝে শব্দ উচ্চারণের স্থান ও এর স্বাতন্ত্রতা এবং এর ‘আরাবী কায়দা কানুন একই রকম নয়। তবুও এর দ্বারা সাওয়াব পাওয়া যায় এবং এটা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি প্রজন্মের কথা ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, যেটা তার মু‘জিযা এর অন্তর্ভুক্ত, যে শীঘ্রই একটি দলের উদ্ভব ঘটবে যারা কুরআনের কিরাআত নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করবে। তারা শব্দকে সুন্দর করার জন্য, তার মাখরাজ ও সিফাতের প্রতি কঠিনভাবে নজর দিয়ে শব্দকে আদায় করার জন্য তীব্র কষ্ট উঠাবে। এটা এবং তারা পার্থিব সুনাম, খ্যাতি অর্জনের এবং লোককে দেখাবার উদ্দেশে করবে। তারা পৃথিবীতে এর প্রতিদান সাওয়াবের আশা করবে। কেউ বলেছেন তারা আল্লাহর আয়াতকে সামান্য মূল্যে বিক্রি করবে কিন্তু তারা পরকালে এর প্রতিদানের আশা করবে না তারা শুধু খেয়ে যাবে, আল্লাহর ওপর ভরসা করবে না।
ইমাম জাযরী (রহঃ) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাবি‘ঈদেরকে কিরাআত সহজ ছিল। তিনি বলেন, তোমরা যেভাবে সহজ উচ্চারণ করতে পার সেভাবে কুরআন তেলাওয়াত কর। এক্ষেত্রে হরফ উচ্চারণে কষ্ট কাঠিন্য স্বীকার ও মাদ্দ, হামজা উচ্চারণে ও ইশ্বা করণে বাড়াবাড়ি ও অতিরিক্ত করার দরকার নেই।
২২০৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২০৭
وَعَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «اِقْرَؤُوا الْقُرْاٰنَ بِلُحُونِ الْعَرَبِ وَأَصْوَاتِهَا وَإِيَّاكُمْ وَلُحُونَ أَهْلِ الْعِشْقِ وَلُحُوْنَ أَهْلِ الْكِتَابَيْنِ وَسَيَجِىئُ بَعْدِىْ قوم يرجعُونَ بِالْقُرْاٰنِ ترجع الْغِنَاءِ وَالنَّوْحِ لَا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ مَفْتُونَهٌ قُلُوبُهُمْ وَقُلُوبُ الَّذِينَ يُعْجِبُهُمْ شَأْنُهُمْ». رَوَاهُ الْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيْمَانِ
হুযায়ফাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআন পড়ো ‘আরবদের স্বর ও সুরে। আর দূরে থাকো আহলে ইশক ও আহলে কিতাবদের পদ্ধতি হতে। আমার পর খুব তাড়াতাড়ি এমন কিছু লোকের আগমন ঘটবে, যারা কুরআন পাঠে গান ও বিলাপের সুর ধরবে। কুরআন মাজীদ তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করে অন্তরের দিকে যাবে না। তাদের অন্তর হবে দুনিয়ার মোহগ্রস্ত। এভাবে তাদের অন্তরও মোহগ্রস্ত হবে যারা তাদের পদ্ধতি ও সুরে কুরআন তিলাওয়াত করবে। (বায়হাক্বী- শু‘আবূল ঈমান)[১]
ইমাম জাযরী (রহঃ) বলেন, কুরআন তিলাওয়াত এমন সুরেলা আওয়াজে করতে হবে যেন হরফসমূহ তার মাখারিজ থেকে বিচ্যুত ও ত্রুটিযুক্ত না হয়, কারণ এর দ্বারা প্রফুল্লতা বা আনন্দ বৃদ্ধি পায়।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেমিক তথা মুসলিম পাপী-ফাসিকদের সুরে কুরআন পড়তে নিষেধ করেছেন। তারা সুরকে টেনে এমনভাবে দীর্ঘ করে ফলে অক্ষর কম-বেশি হয়ে যায়। আর এটা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। أهل العشق এর সুর থেকে উদ্দেশ্য হলো যা কোন লোক নারীর প্রেম বিষয়ক কবিতা সুরকারের নিয়ম-নীতির প্রতি লক্ষ্য রেখে কষ্ট করে পড়ে থাকে।
অনুরূপভাবে ইয়াহূদী ও নাসারা তাদের কিতাব তথা তাওরাত ও ইঞ্জীলকে গায়কদের মতো তিলাওয়াত করত। তাই তাদের মতো কুরআন তিলাওয়াত করা নিষিদ্ধ। সেজন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ من تشبه بقوم فهو منهم। এ ধরনের সুরে যারা কুরআনের আওয়াজকে গায়কদের মতো বরাবর ফিরিয়ে বিলাপের সুরে তিলাওয়াত করে কুরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। অর্থাৎ- তাদের অন্তরে কুরআন তিলাওয়াতের প্রভাব পড়বে না। ফলে তারা কুরআন তিলাওয়াতের ভাবনা করবে না এর প্রতি ‘আমাল করবে না। ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, তিলাওয়াত আসমানে পৌঁছবে না বা গ্রহণযোগ্য হবে না।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একটি দলের উদ্ভব ঘটবে যারা কুরআনকে গান ও বিলাপের মতো বারবার ফিরিয়ে পাঠ করবে। কিন্তু তাদের অন্তরে এর ক্রিয়া হবে না। অর্থাৎ- কুরআন ترجيع-এর পদ্ধতিতে পড়া যাবে না। যে গান ও বিলাপকে ترجيع করা হয়। তবে অন্য হাদীসে উম্মু হানী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন ترجيع করেছেন। যেমন তিনি বলেন, (كنت أسمع صوت النبي - ﷺ- وهو يقرأ وأنا نائمة على فراشي يرجع القرآن) এছাড়া ইসমা‘ঈলীর বর্ণনায় রয়েছে, যদি আমাদের নিকটে মানুষ একত্রিত না হত তবে আমি গুণগুণ সুরে কুরআন তিলাওয়াত করতাম। এসব বর্ণনা থেকে বুঝা গেল ترجيع করা জায়িয।
ইবনু আবী জামরাহ্ এর উত্তরে বলেন, এখানে ترجيع বলতে সুন্দর সুমধুর কন্ঠে তিলাওয়াত উদ্দেশ্য। গানের সুর উদ্দেশ্য নয়। কারণ কুরআন পড়ার দ্বারা যে বিনম্রতার আশা করা যায় গানের ترجيع দ্বারা এর বিপরীত হয়।
২২০৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২০৮
وَعَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ يَقُولُ: «حَسِّنُوا الْقُرْاٰنَ بِأَصْوَاتِكُمْ فَإِنَّ الصَّوْتَ الْحَسَنَ يُزِيدُ الْقُرْاٰنَ حُسْنًا». رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ
বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআনকে তোমাদের কণ্ঠস্বরের মধুর আওয়াজ দিয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে পড়বে। কারণ সুমিষ্ট স্বর কুরআনের সৌন্দর্য বাড়ায়। (দারিমী)[১]
২২০৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২০৯
وَعَنْ طَاوُوسٍ مُرْسَلًا قَالَ: سُئِلَ النَّبِىُّ ﷺ: أَيُّ النَّاسِ أَحْسَنُ صَوْتًا لِلْقُرْاٰنِ؟ وَأَحْسَنُ قِرَاءَةً؟ قَالَ: «مَنْ إِذَا سَمِعْتَه يقْرَأ أَرَأَيْت أَنَّه يَخْشَى اللّٰهَ». قَالَ طَاوُوسٌ: وَكَانَ طَلْقٌ كَذَلِكَ. رَوَاهُ الدَّارِمِىُّ
ত্বাঊস ইয়ামানী (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একবার নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হলো, (হে আল্লাহর নাবী!) কুরআনে স্বর প্রয়োগ ও উত্তম তিলাওয়াতের দিক দিয়ে কোন্ ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যার তিলাওয়াত শুনে তোমার মনে হবে, তিলাওয়াতকারী আল্লাহকে ভয় করছে। বর্ণনাকারী ত্বাঊস বলছেন, ত্বালক্ব (রহঃ) এরূপ তিলাওয়াতকারী ছিলেন। (দারিমী)[১]
‘আল্লামা ‘আবদুল হক দেহলভী (রহঃ) তাঁর ‘‘আল লাম্‘আত’’ গ্রন্থে বলেন, কারী তার সুন্দর সুরের মাধ্যমে ভয়, চিন্তার নিদর্শন প্রকাশ করবে। আসলে পাঠকের ভীতি তার আওয়াজে বুঝা যাবে। এরূপ কন্ঠস্বর হলে সেটা উত্তম সুর।
ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, কুরআনের পাঠক সুমধুর সুরের মাধ্যমে আল্লাহ ভীতির জবাব প্রদানে ব্যস্ত থাকবে। যা কারী ও মনোযোগী শ্রোতার নিকটে প্রকাশ পায়। যেমন তাবি‘ঈ ত্বালক্ব বিন হাবীব ‘আনাযী আল বাসরী।
২২১০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২১০
وَعَنْ عُبَيْدَةَ الْمُلَيْكِىِّ وَكَانَتْ لَه صُحْبَةٌ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «يَا أَهْلَ الْقُرْاٰنِ لَا تَتَوَسَّدُوا الْقُرْاٰنَ وَاتْلُوهُ حَقَّ تِلَاوَتِه مِنْ اٰنَاءِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَأَفْشُوهُ وَتَغَنُّوهُ وَتَدَبَّرُوا مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ وَلَا تَعْجَلُوا ثَوَابَه فَإِنَّ لَه ثَوَابًا». رَوَاهُ الْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيْمَانِ
উবায়দাহ্ আল মুলায়কী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি ছিলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহচর। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে কুরআনের বাহকগণ! কুরআনকে তোমরা বালিশ বানাবে না। বরং তা তোমরা রাতদিন তিলাওয়াত করার মতো তিলাওয়াত করবে। কুরআনকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে সুর করে পড়বে। কুরআনের বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে পড়বে। তাহলেই তোমরা সফলতা অর্জন করবে। দুনিয়ায় এর প্রতিফল পাবার জন্য তাড়াহুড়া করো না। কারণ আখিরাতে এর উত্তম প্রতিফল রয়েছে। (বায়হাক্বী- শু‘আবূল ঈমান)[১]
কারী বলেছেন, তোমরা কুরআনকে বালিশ করো না। কেননা এরূপ করলে কুরআনের হক আদায়ে তোমরা অলস এবং অমনোযোগী হয়ে পড়বে। বরং কুরআন জেনে, বুঝে, ‘আমাল করে, তিলাওয়াত করে এর হক আদায়ে ব্রতি হও। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনকে দিনে রাতে যথাযথভাবে তিলাওয়াত করতে ও এর অনুসরণ করতে বলেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো নির্দেশ দিয়েছেন যে, কুরআন জানা ব্যক্তিরা যেন কুরআনকে শোনান, শিক্ষা দেয়া, লিখা, ব্যাখ্যা করা, চর্চা করা ও তার প্রতি ‘আমাল করার মাধ্যমে প্রচার করে। আর তারা যেন সুন্দর কণ্ঠে তিলাওয়াত করে এবং এর মর্মার্থ অনুধাবন করে পরকালে এর জন্য সাওয়াবের আশা করে। কারণ এর দ্বারা দুনিয়াতে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা যাবে না। পরকালে এর সাওয়াব বিশাল বড়।
أهل القرآن -কে বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো এই যে, কুরআন জানা ব্যক্তির ওপর এর দায়িত্ব বেশি। কারণ অন্যদের তুলনায় তারা কুরআন হক সম্পর্কে বেশি অবগত। তাই তাদের ওপর এটা ওয়াজিব।
অথবা এর দ্বারা মু’মিনগণ উদ্দেশ্য। কেননা তাদের কমপক্ষে অল্প হলেও কুরআন জানা থাকে। অথবা এর দ্বারা কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী উদ্দেশ্য।
২২১১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২১১
وَعَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ قَالَ: سَمِعْتُ هِشَامَ بْنَ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ يَقْرَأُ سُوْرَةَ الْفُرْقَانِ عَلٰى غَيْرِ مَا أَقْرَأَهَا. وَكَانَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ أَقْرَأَنِيهَا فَكِدْتُ أَنْ أَعْجَلَ عَلَيْهِ ثُمَّ أَمْهَلْتُه حَتَّى انْصَرَفَ ثُمَّ لَبَّبْتُه بِرِدَائِه فَجِئْتُ بِه رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ. فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ إِنِّىْ سَمِعْتُ هٰذَا يَقْرَأُ سُورَةَ الْفُرْقَانِ عَلٰى غَيْرِ مَا أَقْرَأْتَنِيهَا. فَقَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: أَرْسِلْهُ اقْرَأ فَقَرَأت الْقِرَاءَةَ الَّتِىْ سَمِعْتُه يَقْرَأُ. فَقَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «هَكَذَا أُنْزِلَتْ». ثُمَّ قَالَ لِىْ: «اِقْرَأ». فَقَرَأْتُ. فَقَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «هَكَذَا أُنْزِلَتْ إِنَّ هٰذَا الْقُرْاٰنَ أُنْزِلَ عَلٰى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ فَاقْرَءُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ». مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ، وَاللَّفْظُ لِمُسْلِمٍ
উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি হিশাম ইবনু হাকীম ইবনু হিযামকে ‘সূরা আল ফুরকান’ পাঠ করতে শুনলাম। আমি যেভাবে (কুরআন) পড়ি, তা হতে (তার পড়া) ভিন্ন ধরনের, অথচ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আমাকে এ সূরা পড়িয়েছেন। তাই আমি এর কারণে ব্যস্ত হতে উদ্যত হলাম। কিন্তু সলাত শেষ করা পর্যন্ত তাকে সুযোগ দিলাম। সলাত শেষ হবার পরই তার চাদর তার গলায় পেঁচিয়ে আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে যেভাবে ‘সূরা আল ফুরকান’ পড়িয়েছেন তার থেকে ভিন্নরূপে আমি হিশামকে ‘সূরা আল ফুরকান’ পড়তে শুনলাম।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘উমারকে বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। হিশামকে বললেন, হিশাম! তুমি ‘সূরা আল ফুরকান’ পড়ো তো দেখি। হিশাম এ সূরাটি সেভাবেই পড়ল আমি তাকে যেভাবে পড়তে শুনেছি। তার পড়া শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এভাবেও এ সূরা নাযিল হয়েছে। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, এখন তুমিও পড়ো দেখি! আমিও সূরাটি পড়লাম। আমার পড়া শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ সূরাটি এভাবেও নাযিল হয়েছে। বস্ত্তত এ কুরআন সাত রীতিতে নাযিল করা হয়েছে। তাই তোমাদের যার জন্য যে কিরাআত সহজ হয় সেভাবেই তোমরা পড়বে। (বুখারী, মুসলিম; কিন্তু পাঠ [শব্দ] মুসলিমের)[১]
আবূ শামাহ বলেন, হয়তো কুরআন প্রথমে তিন রীতিতে এবং পরে সাত রীতিতে নাযিল হয়েছে। কেউ বলেছেন, এখান থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যা ধর্তব্য নয়। বরং এর দ্বারা সহজতা, প্রশস্ততা, সম্মান ও দয়া উদ্দেশ্য।
‘উলামাগণ سبعة أحرف-এর অর্থ ও ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক মতামত ব্যক্ত করেছেন।
‘আল্লামা সুয়ূত্বী (রহঃ) তাঁর اتقان গ্রন্থে বলেন, এ হাদীসের অর্থের ব্যাপারে চল্লিশটি মত রয়েছে, তন্মধ্যে একটি মত হচ্ছে, حرف-এর অর্থ নির্ণয় করা কঠিন। কেননা حرف বলতে সাধারণ বানানো অক্ষর উদ্দেশ্য হতে পারে। আবার শব্দকে বুঝায় অর্থকে ও বুঝায় আবার ‘‘দিক’’ এর অর্থ দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, পছন্দনীয় অভিমত হচ্ছে এটা متشابهة-এর অন্তর্ভুক্ত। এর সঠিক ব্যাখ্যা বলা যায় না।
কেউ কেউ সাত হরফ বলতে সাতটি গোত্র উদ্দেশ্য। যেমন- কুরায়শ, হাওয়াযিন, তামীম, হুযায়ল, আযদ, রবী‘আহ্, সা‘দ বিন বাকর ইত্যাদি। ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, সাত হরফ বলতে সাতটি ধরন উদ্দেশ্য। যদি একটি রীতিতে পড়তে বলা হত তাহলে কারীদের নিকটে কঠিন হতো। তাই যাতে তারা তাদের সহজ ভাষাতে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে সেজন্য এই প্রশস্ততা দান করা হয়েছে।
কেউ কেউ সাতটি গোত্র বা সাতটি ভাষাকে মেনে নিতে চাননি। তারা বলেন, ‘উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ও হিশাম বিন হাকীম (রাঃ) উভয়েই কুরায়শ বংশের একই গোত্রের একই ভাষার অথচ তাদের পড়ার ধরন দুই ধরনের।
এ ধরনের মতভেদের সমাধানে ইমাম ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, سبعة أحرف এর দ্বারা একই অর্থের বিভিন্ন শব্দ উদ্দেশ্য। যেমন أقبل – هلم - تعالى ইত্যাদি।
ইবনু ‘আবদুল বার (রহঃ) বলেন, অধিকাংশ ‘আলিম এ মতটি গ্রহণ করেছেন। সাত ধরনের শব্দ মানে সাত ধরনের পরিবর্তন; যেমন-
১. হরকতের বিভিন্নতা, যেমন- يُضَارُّ ও يُضَارَّ।
২. فعل গত পরিবর্তন যথা: فعل الأمر -_ بَاعِدْ এবং فعلى الماضى _ بَعُدَ।
৩. নুক্তার পরিবর্তন। যথা: نُنْسَزُهَا ও نُنْسَرُهَا।
৪. নিকটবর্তী মাখরাজের হরফের পরিবর্তন করে। যথা: طلح منضود ও طلع منضود।
৫. تقديم ও تأخير এর পরিবর্তন। যথা: وجاءت سكرة بالموت بالحق কে جاءت سكرة الحق بالموت পড়া।
৬. অক্ষর কম-বেশি করে। যথা: والذكر والأنثى বা وما خلق الذكر والأنثى।
৭. অন্য সমার্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা। যথা: كالعهن المنفوش [القارعة: 5] বা والصوف المنفوش।
আবার সাত প্রকার থেকে أمثال ও اهد، نهى، وعد،وعيد، قصص، حلال، حرام, محكم، متشابه হতে পারে।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেছেন, ‘আরবরা বিভিন্ন ভাষার অধিকারী ছিল। তাই তাদের মাঝে إدغام وإظهار وتفخيم وترقيق وإمالة وإشباع ইত্যাদির ক্ষেত্রে উচ্চারণগত পার্থক্য ছিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের পড়ার সহজতার জন্য এই প্রশস্ততা দান করেছেন। প্রথমে কুরআন কুরায়শদের ভাষায় নাযিল করেছেন। এরপর যখন অন্যান্য ‘আরবরা ইসলাম গ্রহণ করল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের ভাষা অনুযায়ী পড়ার জন্য অনুমতির ব্যবস্থা করেন।
মতানৈক্যের কারণ: ইবনু আবী হাশিম বলেন, সাহাবীগণ কুরআন শুনে বিনা নুকতায় লিখত। তাদের নিকট থেকে বিভিন্ন এলাকার মানুষ গ্রহণ করত। তাদের নিকটে যেরূপ কুরআন থাকত সেটার ব্যতিক্রমটিকে বর্জন করত। এটা ‘উসমান (রাঃ)-এর নির্দেশের কারণে। ফলে কারীদের মাঝে কিরাআতের ভিন্নতা দেখা দেয়।
হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) একটি গ্রহণযোগ্যতা বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে সর্বসম্মতিক্রমে একটি মাসহাফ লিখিত হয়। কিন্তু তাতে কিছু বর্ণের ভিন্নতা ছিল। এছাড়া যা অন্য কিরাআত আছে সেগুলোকে আল্লাহ মানুষের সুবিধার জন্য সহজভাবে বিভিন্নভাবে পড়ার বৈধতা দান করেন। কিন্তু যখন ‘উসমানের আমলে কোন মানুষ অন্য কারো পঠনকে অস্বীকার করল এবং কাফির বলে অভিহিত করতে শুরু করল তখন ‘উসমান একটি রীতিতে কুরআন সংকলন করলেন অন্যগুলোকে ছেড়ে দিলেন কিন্তু অন্যভাবে পড়ার বৈধতা থাকল। তাই মহান আল্লাহ বললেন, فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ অর্থাৎ- ‘‘যেভাবে সহজ সেভাবে পড়’’- (সূরা আল মুযযাম্মিল ৭৩ : ২০)।
২২১২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২১২
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: سَمِعْتُ رَجُلًا قَرَأَ وَسَمِعْتُ النَّبِىَّ ﷺ يَقْرَأُ خِلَافَهَا فَجِئْتُ بِهِ النَّبِىَّ ﷺ فَأَخْبَرْتُه فَعَرَفْتُ فِىْ وَجْهِهِ الْكَرَاهِيَّةَ فَقَالَ: «كِلَاكُمَا مُحْسِنٌ فَلَا تَخْتَلِفُوْا فَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ اِخْتَلَفُوْا فَهَلَكُوْا». رَوَاهُ البُخَارِىُّ
আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি এক লোককে কুরআন পড়তে শুনলাম। অথচ আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অন্যভাবে তা পড়তে শুনেছি। আমি তাকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে গেলাম। তাঁকে এ খবর জানালাম। আমি তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারায় বিরক্তির ভাব লক্ষ্য করলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমরা দু’জনই শুদ্ধ পড়েছ। এ নিয়ে তোমরা কলহ বিবাদ করো না। তোমাদের আগের লোকেরা কলহ-বিবাদে লিপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছেন। (বুখারী)[১]
কুসত্বুলানী (রহঃ) বলেন, যদি কেউ প্রশ্ন করে যে তাদের দু’জনের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হলেও কিভাবে তাদেরকে محسن বা সঠিক বলে আখ্যায়িত করলেন। তবে উত্তরে বলা যাবে محسن এজন্য বললেন যে, ইবনু মাস্‘ঊদ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শোনার পর আবার সঠিকতা অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন এবং সেই ব্যক্তিটি ভালভাবে পড়েছে। আর উভয়ে ঝগড়া করার কারণে অপছন্দ করেছেন। কারণ তাদের উচিত ছিল প্রত্যেকের কিরাআতকে স্বীকৃতি দেয়া এবং এর কারণ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জানতে চাওয়া।
কারী বলেন, ইবনু মাস্‘ঊদ কুরআনের বিভিন্ন পঠন পদ্ধতির বৈধতা সম্পর্কে অবগত হওয়ার আগেই এই রকম বিতর্কে জড়িয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ইবনু মাস্‘ঊদ লোকটিকে নিয়ে আসার কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপছন্দ করেন। কেননা তার উচিত ছিল লোকটির ব্যাপারে ভাল ধারণা করা এবং লোকটির কিরাআতের বিষয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জানতে চাওয়া। অথবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে যখন ‘উমার এ ধরনের বিষয় নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন তিনি তার ওপর ধৈর্য ধারণ করেছিলেন, কারণ তার রাগ সম্পর্কে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জানা ছিল। কিন্তু ইবনু মাস্‘ঊদ -এর এত রাগ না থাকা সত্ত্বেও ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ার কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারায় অপছন্দের ছাপ ফুটে উঠেছিল।
ইবনু মালিক বলেন, লোকটির সাথে ইবনু মাস্‘ঊদ-এর মতভেদের কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখমন্ডলে অপছন্দের ছাপ দেখা গেছে। কারণ বিভিন্নভাবে কুরআন তিলাওয়াত জায়িয। আর কোন পদ্ধতিতে অস্বীকার করা যেন কুরআনকে অস্বীকার করা। আর এটা না জায়িয।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাতদেরকে ইখতেলাফ করতে নিষেধ করেছেন। কুসতুলানী (রহঃ) لا تختلفوا এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, তোমরা এমন এখতেলাফ করো না যা তোমাদেরকে কুফরী অথবা বিদ্‘আতে নিমজ্জিত করে। যেমন স্বয়ং কুরআন সম্পর্কে মতানৈক্য করা। অথবা যাতে ফিতনার বা সন্দেহের মধ্যে মানুষ পড়ে যায় এমন ইখতেলাফ করা।
২২১৩
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২১৩
وَعَنْ أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ قَالَ: كُنْتُ فِى الْمَسْجِدِ فَدَخَلَ رَجُلٌ يُصَلِّىْ فَقَرَأَ قِرَاءَةً أَنْكَرْتُهَا عَلَيْهِ ثُمَّ دَخَلَ اٰخَرُ فَقَرَأَ قِرَاءَةً سِوٰى قِرَاءَةِ صَاحِبِه فَلَمَّا قَضَيْنَا الصَّلَاةَ دَخَلْنَا جَمِيعًا عَلٰى رَسُولِ اللّٰهِ ﷺ فَقُلْتُ إِنَّ هٰذَا قَرَأَ قِرَاءَةً أَنْكَرْتُهَا عَلَيْهِ وَدَخَلَ اٰخَرَ فَقَرَأَ سِوٰى قِرَاءَةِ صَاحِبِه فَأَمَرَهُمَا النَّبِىُّ ﷺ فَقَرَاٰ فَحَسَّنَ شَأْنَهُمَا فَسَقَطَ فِىْ نَفْسِىْ مِنَ التَّكْذِيبِ وَلَا إِذْ كُنْتُ فِى الْجَاهِلِيَّةِ فَلَمَّا رَأَى رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ مَا قَدْ غَشِيَنِىْ ضَرَبَ فِىْ صَدْرِىْ فَفِضْتُ عَرَقًا وكَأَنَّمَا أَنْظُرُ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ فَرَقَا فَقَالَ لِىْ: «يَا أُبَىُّ أُرْسِلَ إِلَىَّ أَنْ اَقْرَأِ الْقُرْاٰنَ عَلٰى حَرْفٍ فَرَدَدْتُ إِلَيْهِ أَنْ هَوِّنْ عَلَى امَّتِىْ فَرَدَّ إِلَىَّ الثَّانِيَةَ اقْرَأْهُ عَلٰى حَرْفَيْنِ فَرَدَّدَتْ إِلَيْهِ أَنْ هَوِّنْ عَلَى امَّتِىْ فَرَدَّ إِلَىَّ الثَّالِثَةِ اقْرَأْهُ عَلٰى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ وَلَكَ بِكُلِّ رَدَّةٍ رَدَدْتُكَهَا مَسْأَلَةٌ تَسْأَلُنِيهَا فَقُلْتُ اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِأُمَّتِىْ اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِأُمَّتِىْ وَأَخَّرْتُ الثَّالِثَةَ لِيَوْمٍ يَرْغَبُ إِلَىَّ الْخَلْقُ كُلُّهُمْ حَتّٰى اِبْرَاهِيْمُ ؑ». رَوَاهُ مُسْلِمٌ
উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি মাসজিদে আছি, এমন সময় এক লোক মাসজিদে এসে সলাত আদায় করতে শুরু করল। সে এমন পদ্ধতিতে কিরাআত পড়ল যা আমার জানা ছিল না। এরপর আর একজন লোক এলো। সে প্রথম ব্যক্তির কিরাআতের ভিন্ন ধরনে পড়ল। সলাত শেষে আমরা সকলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গেলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! এ ব্যক্তি সলাতে এভাবে কিরাআত পড়েছে, যা আমার জানা নেই। আবার দ্বিতীয় ব্যক্তি এসে ওর চেয়ে ভিন্নভাবে কিরাআত পড়ল। এসব কথা শুনে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে হুকুম দিলেন, আবার কুরআন পড়তে। তারা আবার পড়ল। পড়া শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উভয়ের পাঠকেই ঠিক বললেন। এ কথা শুনে আমার মনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এমন এক সন্দেহের জন্ম দিলো যা জাহিলিয়্যাতের সময়েও আমার মধ্যে ছিল না। সন্দেহের ছায়া আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে লক্ষ্য করে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার সিনার উপর হাত মারলেন। এতে আমি ঘামে ভিজে গেলাম।
আমি এতই ভীত হলাম, যেন আমি আল্লাহকে দেখছি। এ সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, হে উবাই! আমার কাছে ওহী পাঠানো হয়েছিল এক রীতিতে কুরআন পাঠের। কিন্তু আমি আল্লাহর নিকট আবেদন করলাম। (হে আল্লাহ!) আপনি আমার উম্মাতের জন্য কুরআন পাঠ পদ্ধতি সহজ করে দিন। আল্লাহ দ্বিতীয়বার বললেন, তবে দু’ রীতিতে কুরআন পড়ো। আমি আবার নিবেদন করলাম, (হে আল্লাহ!) আপনি আমার উম্মাতের জন্য কুরআন পাঠ আরো সহজ করে দিন। তিনি তৃতীয়বার আমাকে বলে দিলেন, তাহলে সাত রীতিতে কুরআন পড়ো। কিন্তু তোমার প্রতিটি নিবেদনের পরিবর্তে আমি তোমাকে যা দিয়েছি এর বাইরেও আরো নিবেদন অধিকার তোমার রইল। তুমি তা চাইতে পারো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন। আর তৃতীয় আবেদনটি আমি এমন এক দিনের জন্য পিছিয়ে রাখলাম যেদিন সব সৃষ্টি আমার সুপারিশের দিকে চেয়ে থাকবে। এমনকি ইব্রাহীম (আঃ)-ও। (মুসলিম)[১]
ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেছেন, উবাই বিন কা‘ব ছিলেন উঁচু স্তরের সাহাবী ও দৃঢ় বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত। আসলে তাদের দু’জনের ভিন্ন কিরাআতকে শুদ্ধ বলায় উবাই-এর অন্তরে শয়তানের কুমন্ত্রণা সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতের দ্বারা প্রহারের বারাকাতে তার ভয়-ভীতি ঘামের সাথে বের হয়ে গেল। তিনি দৃঢ় বিশ্বাসী হলেন। এ সময় তিনি যেন শায়ত্বনী কুমন্ত্রণার কারণে লজ্জিত হয়ে ভয়ে আল্লাহর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৃতীয় প্রার্থনা পিছিয়ে দিয়েছেন কিয়ামাতের দিনে আবেদন করার জন্য। তৃতীয় আবেদনটি হচ্ছে الشفاعة الكبراى (বড় সুপারিশ)। সমস্ত সৃষ্টি জীবের এই সুপারিশের প্রয়োজন রয়েছে। এমনকি ইব্রাহীম (আঃ)-এরও প্রয়োজন আছে। এ উক্তি দ্বারা ইব্রাহীম (আঃ)-এর মর্যাদা অন্যান্য নাবীদের ওপর ও আমাদের নাবীর শ্রেষ্ঠত্ব সকল নাবী-রসূলের ওপর প্রমাণিত হয়।
২২১৪
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২১৪
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمَا قَالَ: إِنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ قَالَ: «أَقْرَأَنِىْ جِبْرِيْلُ عَلٰى حَرْفٍ فَرَاجَعْتُه فَلَمْ أَزَلْ اَسْتَزِيْدُه وَيَزِيْدُنِىْ حَتَّى انْتَهٰى إِلٰى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ». قَالَ ابْنُ شِهَابٍ: بَلَغَنِىْ أَنَّ تِلْكَ السَّبْعَةَ الْأَحْرُفَ إِنَّمَا هِىَ فِى الْأَمْرِ تَكُونُ وَاحِدًا لَا تَخْتَلِفُ فِىْ حَلَالٍ وَلَا حرَامٍ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জিবরীল (আঃ) আমাকে এক রীতিতে কুরআন পড়ালেন। আমি তাকে এর পাঠ রীতির সংখ্যা বৃদ্ধি করে আনতে আল্লাহর নিকট ফেরত পাঠালাম। আল্লাহ আমার জন্য এ রীতি বৃদ্ধি করতে লাগলেন। অতঃপর এ পাঠ সাত রীতিতে গিয়ে পৌঁছল।
বর্ণনাকারী ইবনু শিহাব যুহরী বলেন, বিশ্বস্ত সূত্রে আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, এ সাত রীতি অর্থের দিক দিয়ে একই। এর দ্বারা হালাল হারামে কোন পার্থক্য পড়েনি। (বুখারী, মুসলিম)[১]
বায়হাক্বী (রহঃ) বলেছেন, একটি শব্দ দুই তিন থেকে সাত পদ্ধতিতে পড়া যায় যাতে সজহভাবে বা কষ্ট ছাড়াই পড়া সুবিধা হয়। ইমাম ত্বহাবী (রহঃ)-এর নিকটে সাতভাবে পড়া বলতে হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল করা যাবে না। এই পরিবর্তন শুধু শব্দের ভিতরে হবে অর্থে নয়। অর্থাৎ- শব্দের অর্থ ঠিক রেখে রূপ পরিবর্তন করা কুরআন মাজীদে জায়িয।
মাওয়ার্দী স্পষ্টভাবে বলেছেন, যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিরাআতের ক্ষেত্রে একটি অক্ষরকে অন্য একটি অক্ষরের সাথে পরিবর্তন করার ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। আর মুসলিমগণ امثال -এর আয়াতকে أحكام-এর সাথে পরিবর্তন করা হারাম মর্মে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
আহমাদ ও বায়হাক্বী বলেছেন, مثبت-কে منفي এবং حلال-কে হারামে পরিবর্তন করা কুরআনে জায়িয নয়। আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا ‘‘যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট হতে আসতো, তবে তাতে তারা অবশ্যই বহু অসঙ্গতি পেত’’- (সূরা আন্ নিসা ৪ : ৮২)। আর এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে হওয়াই এতে সামান্যতম মতভেদ পাওয়া যাবে না।
২২১৫
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২১৫
عَنْ أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ قَالَ: لَقِىَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ جِبْرِيلَ فَقَالَ: «يَا جِبْرِيلُ إِنِّىْ بُعِثْتُ إِلٰى أُمَّةٍ أُمِّيِّينَ مِنْهُمُ الْعَجُوزُ وَالشَّيْخُ الْكَبِيرُ وَالْغُلَامُ وَالْجَارِيَةُ وَالرَّجُلُ الَّذِىْ لَمْ يَقْرَأْ كِتَابًا قَطُّ قَالَ: يَا مُحَمَّدُ إِنَّ الْقُرْاٰنَ أُنْزِلَ عَلٰى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَفِىْ رِوَايَةٍ لِأَحْمَدَ وَأَبِىْ دَاوُدَ: قَالَ: «لَيْسَ مِنْهَا إِلَّا شَافٍ كَافٍ». وَفِىْ رِوَايَةٍ لِلنَّسَائِىِّ قَالَ: «إِنَّ جِبْرِيلَ وَمِيكَائِيلَ أَتَيَانِىْ فَقَعَدَ جِبْرِيلُ عَنْ يَمِينِىْ وَمِيكَائِيلُ عَنْ يَسَارِىْ فَقَالَ جِبْرِيلُ: اقْرَأِ الْقُرْاٰنَ عَلٰى حَرْفٍ قَالَ مِيكَائِيلُ: اسْتَزِدْهُ حَتّٰى بَلَغَ سَبْعَةَ أَحْرَفٍ فَكُلُّ حَرْفٍ شَافٍ كَافٍ
উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীলের সাথে দেখা করলেন। তিনি বললেন, হে জিবরীল! আমি এক নিরক্ষর উম্মাতের কাছে প্রেরিত হয়েছি। এদের মধ্যে আছে প্রবীণা বৃদ্ধা, প্রবীণ বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী। এমন ব্যক্তিও আছে যে কখনো লেখাপড়া করেনি। জিবরীল বললেন, হে মুহাম্মাদ! (এতে ভয় নেই) কুরআন সাত রীতিতে (পড়ার অনুমতি নিয়ে) নাযিল হয়েছে। (তিরমিযী।)
আহমদ ও আবূ দাঊদের এক বর্ণনায় আরো আছে, ‘‘এদের প্রত্যেক পাঠই (অন্তর রোগের জন্য) নিরাময় দানকারী ও যথেষ্ট। কিন্তু নাসায়ীর এক বর্ণনায় আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, জিবরীল ও মীকাঈল আমার নিকট এলেন। জিবরীল আমার ডানদিকে ও মীকাঈল বাম দিকে বসলেন। জিবরীল বললেন, আপনি আমার কাছ থেকে কুরআন পড়ার রীতি শিখে নিন। তখন মীকাঈল বললেন, আপনি তার নিকট কুরআন পড়ার রীতি বৃদ্ধির আবেদন করুন। আমি তা করলাম। অতঃপর এ রীতি সাত পর্যন্ত পৌঁছল। তাই এ সাত রীতির প্রত্যেকটাই আরোগ্য দানকারী ও যথেষ্ট।[১]
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِى الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ ‘‘তিনিই নিরক্ষরদের মাঝে পাঠিয়েছেন তাঁর রসূলকে তাদেরই মধ্য হতে’’- (সূরা আল জুমাহ্ ৬২ : ২)।
আবার কেউ বলেছেন أمى বলা হয়, যারা লিখতে ও কোন কিতাব পড়তে পারে না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ (إنا أمة أمية لا نكتب ولا نحسب) অর্থাৎ- আমরা এমন এক নিরক্ষর জাতি যারা লিখতে পারে না ও হিসাব করতে জানে না। যাদের মধ্যে রয়েছে عجوز বা বৃদ্ধা মহিলা ও الشيخ الكبير বা বৃদ্ধা লোক- এরা বার্ধক্যজনিত কারণে শিখতে অপারগ। الغلام ও الجارية ছোট ছেলে-মেয়ে শৈশবকালে থাকায় পড়তে সক্ষম হয় না। এরা যাতে সহজে পড়তে পারে সেই ব্যবস্থা করুন। তাই জিবরীল বললেন, কুরআন নাযিল হয়েছে সাত রীতিতে।
প্রত্যেকটি রীতিকে মূর্খতা রোগের আরোগ্য দানকারী এবং সলাতের জন্য যথেষ্ট করা হয়েছে। অথবা উদ্দেশ্যবোধ রোগের নিরাময়কারী এবং অলঙ্কার প্রকাশে অপারগ ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট।
মিরকাত গ্রন্থ প্রণেতা বলেন, অর্থ সঙ্গতি বিধানে মু’মিন বক্ষের নিরামক এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সততা প্রমাণে যথেষ্ট।
২২১৬
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২১৬
وَعَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمَا أَنَّه مَرَّ عَلٰى قَاصٍّ يَقْرَأُ ثُمَّ يَسْأَلُ. فَاسْتَرْجَعَ ثُمَّ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ يَقُولُ: «مَنْ قَرَأَ الْقُرْاٰنَ فَلْيَسْأَلِ اللهِ بِه فَإِنَّه سَيَجِىْئُ أَقْوَامٌ يَقْرَؤُوْنَ الْقُرْاٰنَ يَسْأَلُونَ بِهِ النَّاسَ». رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِىُّ
ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একবার তিনি এক গল্পকারের নিকট গেলেন। তিনি দেখলেন, সে গল্পকার কুরআন পড়ছে। আর মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইছে। (এ দৃশ্য দেখে) তিনি দুঃখে ‘ইন্না- লিল্লা-হি’ পড়লেন। এরপর বললেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে সে যেন বিনিময়ে আল্লাহর কাছে কিছু চায়। খুব তাড়াতাড়ি এমন কিছু লোকের আগমন ঘটবে যারা কুরআন পড়ে বিনিময়ে মানুষের কাছে হাত পাতবে। (আহমদ ও তিরমিযী)[১]
কুরআন পড়লে দুনিয়া ও আখিরাত সম্পর্কে আল্লাহর নিকটে চাইতে হবে। মানুষের কাছে নয়। হতে পারে যে, পাঠক যখন রহমাতের আয়াত পড়বে তখন সে আল্লার কাছে চাইতে। আর যখন শাস্তি সংক্রান্ত আয়াত পাঠ করবে- সে তখন তা থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। আর তিলাওয়াতের শেষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বর্ণিত দু‘আর মাধ্যমে প্রার্থনা করবে। আর তার দু‘আ পরকালীন ও মুসলিমদের ইহকালে ও পরকালে কল্যাণের জন্য হওয়া উচিত।
২২১৭
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২১৭
عَن بُرَيْدَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ: «مَنْ قَرَأَ الْقُرْاٰنَ يَتَأَكَّلُ بِهِ النَّاسَ جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَوَجْهُه عَظْمٌ لَيْسَ عَلَيْهِ لَحْمٌ». رَوَاهُ الْبَيْهَقِىُّ فِىْ شُعَبِ الْإِيْمَانِ
বুরায়দাহ্ আল আসলামী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে মানুষের কাছে খাবার চাইবে কিয়ামাতের দিন সে এমন এক অবস্থায় উপনীত হবে যে তার চেহারায় হাড় থাকবে, কিন্তু গোশ্ত (গোসত/গোশত) থাকবে না। (বায়হাক্বী- শু‘আবূল ঈমান)[১]
২২১৮
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২১৮
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: كَانَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ لَا يَعْرِفُ فَصْلَ السُّورَةِ حَتّٰى يَنْزِلَ عَلَيْهِ بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ. رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ নাযিল না হওয়া পর্যন্ত সূরাগুলোর মধ্যে পার্থক্য বুঝে উঠতে পারতেন না। (আবূ দাঊদ)[১]
ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এ হাদীস এবং এ অধ্যায়ের শেষ হাদীস প্রকাশ্য দলীল যে, بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ প্রত্যেক সূরার আয়াত। এটা সূরাকে পৃথক করার জন্য বারবার নাযিল করা হয়েছে।
লুম'আত গ্রন্থ প্রণেতা বলেন, উপরোক্ত হাদীস দু’টি প্রমাণ করে যে, এটা প্রত্যেক সূরার অংশ যেমন শাফি‘ঈর মাযহাব বা মত। আমাদের এটা কুরআনের আয়াত যা সূরাকে আলাদা করার জন্য নাযিল হয়েছে।
মির্‘আত প্রণেতা বলেন, মুসলিমদের ইজমা হয়েছে যে, কুরআনের দুই মোড়কের মাঝে যা কিছু আছে সব আল্লাহর কালাম এবং তাদের সম্মতি হয়েছে যে, মাসহাফের সমস্ত লিপিই হচ্ছে আল্লাহর বাণী। তবে তারা জোর দিয়ে বলেছেন যে সূরার নামসমূহ, আয়াতের সংখ্যা ও ‘আমীন’ শব্দ কুরআনের বাহিরের। এসব প্রমাণ করে যে, بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ কুরআনের আয়াত। সেজন্য সূরা তাওবাহ্ ব্যতীত অন্য সব সূরার প্রথমে بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ পড়া সমস্ত কারীগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
২২১৯
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২১৯
وَعَنْ عَلْقَمَةَ قَالَ: كُنَّا بِحِمْصَ فَقَرَأَ ابْنُ مَسْعُودٍ سُورَةَ يُوسُفَ فَقَالَ رَجُلٌ: مَا هَكَذَا أُنْزِلَتْ. فَقَالَ عَبْدُ اللّٰهِ: وَاللّٰهِ لَقَرَأْتُهَا عَلٰى عَهْدِ رَسُولِ اللّٰهِ ﷺ فَقَالَ: «أَحْسَنْتَ» فَبَيْنَا هُوَ يُكَلِّمُه إِذْ وَجَدَ مِنْهُ رِيحَ الْخَمْرِ فَقَالَ: أَتَشْرَبُ الْخَمْرَ وَتُكَذِّبُ بِالْكِتَابِ؟ فَضَرَبَهُ الْحَدَّ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
আলকামাহ্ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা হিম্স শহরে ছিলাম। ওই সময় একবার ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) সূরা ইউসুফ পড়লেন। তখন এক লোক বলে উঠল, এ সূরা এভাবে নাযিল হয়নি। (এ কথা শুনে) ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে এ সূরা পড়েছি। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনে বলেছেন, বেশ ভাল পড়েছ। ‘আলকামাহ্ বলেন, সে তাঁর সাথে কথা বলছিল এ সময় তার মুখ থেকে মদের গন্ধ পাওয়া গেল। ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) তখন বললেন, মদ খাও আর আল্লাহর কিতাবকে মিথ্যা বানাও। এরপর ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) মদপানের অপরাধে তাকে শাস্তি প্রদান করলেন। (বুখারী, মুসলিম)[১]
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, ইবনু মাস্‘ঊদ তাকে দণ্ড দিয়েছেন এটা এজন্য যে, আমীর কর্তৃক তিনি এ দায়িত্ব বিশেষভাবে পেয়েছিলেন।
হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, হয়ত ইবনু মাস্‘ঊদ তাকে আমীরের নিকট সোপর্দ করেছিলেন। আর আমীর তাকে দণ্ড দিয়েছেন। তাই তিনি দণ্ডকে রূপকভাবে নিজের প্রতি সম্বোধন করেছেন।
কুরতুবী (রহঃ) বলেন, এ হাদীসটি যারা গন্ধ পেলে শাস্তি হবে না বলেছেন যেমন হানাফী মতাবলম্বী তাদের বিপক্ষে দলীল।
কারী (রহঃ) বলেন, একটি দলের মতামত হলো এ হাদীসটি থেকে বাহ্যিকভাবে বুঝা যায়, গন্ধ পেলে মদ পান করেছে বলে ধরে নিয়ে তাকে শাস্তি দেয়া যাবে। তবে আমাদের এবং শাফি‘ঈদের মতামত এর বিপরীত। কারণ টক আপেলেও মদের গন্ধ পাওয়া যায়। আর জোর জবরদস্তিতে মদ পান করতে পারে। সম্ভবত ইবনু মাস্‘ঊদ তার নিকট থেকে কোন স্বীকৃতি পেয়েছিলেন অথবা তাকে শাস্তি দিয়েছেন।
ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, এই মাসআলাটি মতানৈক্যপূর্ণ। তবে শ্রেষ্ঠ অভিমত হলো যে, শুধু গন্ধের কারণে শাস্তি দেয়া যাবে না। বরং তার সাথে আর কোন ইঙ্গিত বা প্রমাণ পেতে হবে। যেমন মাতলামী, বমি করা অথবা মদ্যপায়ী লোকের সাথে অবস্থান করা, অথবা মদপানকারী হিসেবে মানুষের নিকটে পরিচিত হওয়া।
২২২০
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২২০
وَعَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ قَالَ: أَرْسَلَ إِلَيَّ أَبُو بَكْرٍ مَقْتَلَ أَهْلِ الْيَمَامَةِ. فَإِذَا عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ عِنْدَه. قَالَ أَبُو بَكْرٍ إِنَّ عُمَرَ أَتَانِىْ فَقَالَ إِنَّ الْقَتْلَ قَدِ اسْتَحَرَّ يَوْمَ الْيَمَامَةِ بِقُرَّاءِ الْقُرْاٰنِ وَإِنِّىْ أَخْشٰى أَنِ اسْتَحَرَّ الْقَتْلُ بِالْقُرَّاءِ بِالْمَوَاطِنِ فَيَذْهَبُ كَثِيرٌ مِنَ الْقُرْاٰنِ وَإِنِّىْ أَرٰى أَنْ تَأْمُرَ بِجَمْعِ الْقُرْاٰنِ قُلْتُ لِعُمَرَ كَيْفَ تَفْعَلُ شَيْئًا لَمْ يَفْعَلْهُ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ؟ فَقَالَ عُمَرُ هٰذَا وَاللّٰهِ خَيْرٌ فَلَمْ يَزَلْ عُمَرُ يُرَاجِعُنِىْ فِيهِ حَتّٰى شَرَحَ اللهُ صَدْرِىْ لِذٰلِكَ وَرَأَيْت الَّذِىْ رَأَى عُمَرُ قَالَ زَيْدٌ قَالَ أَبُو بَكْرٍ إِنَّكَ رَجُلٌ شَابٌّ عَاقِلٌ لَا نَتَّهِمُكَ وَقَدْ كُنْتَ تَكْتُبُ الْوَحْىَ لِرَسُولِ اللّٰهِ ﷺ فَتَتَبَّعِ الْقُرْاٰنَ فَاجْمَعْهُ فَوَاللّٰهِ لَوْ كَلَّفُونِىْ نَقْلَ جَبَلٍ مِنَ الْجِبَالِ مَا كَانَ أَثْقَلَ عَلَىَّ مِمَّا أَمَرَنِىْ بِه مِنْ جَمْعِ الْقُرْاٰنِ قَالَ: قُلْتُ كَيفَ تَفْعَلُونَ شَيْئًا لَمْ يَفْعَلْهُ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ. قَالَ هُوَ وَاللّٰهِ خَيْرٌ فَلَمْ يَزَلْ اَبُوْ بَكْرٍ يُرَاجِعُنِىْ حَتّٰى شَرَحَ اللهُ صَدْرِىْ لِلَّذِىْ شَرَحَ لَه صَدْرَ أَبِىْ بَكْرٍ وَعُمَرَ. فَتَتَبَّعْتُ الْقُرْاٰنَ أَجْمَعُه مِنَ الْعُسُبِ وَاللِّخَافِ وَصُدُورِ الرِّجَالِ حَتّٰى وَجَدْتُ اٰخِرَ سُورَة التَّوْبَةِ اٰيَتَيْنِ مَعَ أَبِىْ خُزَيْمَةَ الْأَنْصَارِىِّ لَمْ أَجِدْهَا مَعَ أَحَدٍ غَيْرِه ﴿لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ﴾ حَتّٰى خَاتِمَةِ بَرَاءَةَ. فَكَانَتِ الصُّحُفُ عِنْدَ أَبِىْ بَكْرٍ حَتّٰى تَوَفَّاهُ اللّٰهُ ثُمَّ عِنْدَ عُمَرَ حَيَاتَه ثمَّ عِنْدَ حَفْصَةَ. رَوَاهُ البُخَارِىُّ
যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, ইয়ামামার যুদ্ধের পর পর খলীফাতুর রসূল আবূ বাকর (রাঃ) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি গেলাম। দেখলাম ‘উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তাঁর কাছে উপবিষ্ট। আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘উমার আমার কাছে এসে খবর দিলেন, ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক কুরআনের হাফেয শহীদ হয়ে গেছেন। আমার আশংকা হয়, বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে এভাবে হাফেয শহীদ হতে থাকলে কুরআনের অনেক অংশ লোপ পেয়ে যাবে। তাই আমি সঙ্গত মনে করি যে, আপনি কুরআনকে মাসহাফ বা কিতাব আকারে একত্রিত করতে হুকুম দেবেন। আবূ বাকর (রাঃ) বলেন, আমি ‘উমারকে বললাম, এমন কাজ কিভাবে আপনি করবেন, যে কাজ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেননি? ‘উমার (রাঃ) উত্তরে বললেন, আল্লাহর শপথ। এটা হবে একটা উত্তম কাজ। ‘উমার (রাঃ) এভাবে আমাকে বার বার বলতে লাগলেন। অতঃপর আল্লাহ এ কাজের গুরুত্ব বুঝার জন্য আমার হৃদয় খুলে দিলেন এবং আমিও এ কাজ করা সঙ্গত মনে করলাম।
যায়দ (রাঃ) বলেন, আবূ বাকর (রাঃ) আমাকে বললেন, তুমি একজন বুদ্ধিমান যুবক যার ব্যাপারে আমাদের কোন সন্দেহ সংশয় নেই। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওহীও তুমি লিখতে। তাই তুমিই কুরআনের আয়াতগুলো খোঁজ করো এবং এগুলো গ্রন্থাকারে (মাসহাফ) একত্র করো। যায়দ (রাঃ) বলেন, তারা যদি আমাকে পাহাড়সমূহের কোন একটিকে স্থানান্তরের দায়িত্ব অর্পণ করতেন তা-ও আমার জন্য কুরআন একত্র করার দায়িত্ব অপেক্ষা অধিক দুঃসাধ্য হত না। যায়দ (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, যে কাজ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেননি, এমন কাজ আপনারা কী করে করবেন? আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! এটা বড়ই উত্তম কাজ। মোটকথা, এভাবে আবূ বাকর (রাঃ) আমাকে বার বার বলতে লাগলেন।
সর্বশেষ আল্লাহ তা‘আলা আমার হৃদয়কেও এ গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য খুলে দিলেন, যে কাজের জন্য আবূ বাকর ও ‘উমারের হৃদয়কে খুলে দিয়েছিলেন। অতএব খেজুরের ডালা, সাদা পাথর, পশুর হাড়, মানুষের (হাফেযদের) অন্তর ও স্মৃতি হতে আমি কুরআনের আয়াত সংগ্রহ করতে লাগলাম। সর্বশেষ আমি সূরা আত্ তাওবার শেষাংশ, ‘লাকদ জা-আকুম রসূলুম মিন আনফুসিকুম’ হতে সূরার শেষ পর্যন্ত সংগ্রহ করলাম আবূ খুযায়মাহ্ আনসারীর কাছ থেকে। এ অংশ আমি তার ছাড়া আর কারো কাছে পাইনি। যায়দ (রাঃ) বলেন, এ লিখিত সহীফাহগুলো আবূ বাকর (রাঃ) এর কাছে ছিল যে পর্যন্ত আল্লাহ তাকে মৃত্যু দেননি। তারপর ছিল ‘উমার (রাঃ)-এর কাছে তাঁর জীবনকাল পর্যন্ত। তারপর তাঁর কন্যা হাফসা (রাঃ)-এর কাছে ছিল। (বুখারী)[১]
(أهل اليمامة) বলতে মুসায়লামাতুল কাযযাব বাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিহত সাহাবীগণ উদ্দেশ্য। যখন মুসায়লামাতুল কাযযাব নবূওয়াত দাবী করল এবং ‘আরবের অনেকের মুরতাদ হওয়ার কারণে নিজেকে শক্তিশালী করে তুলল তখন আবূ বাকর (রাঃ) খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) এর নেতৃত্বে একদল সাহাবীকে মুসায়লামাতুল কাযযাব-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পাঠালেন। তারা ইয়ামামাহ্ অঞ্চলে গিয়ে তার সাথে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হলে আল্লাহ তা‘আলা মুসায়লামাহ্-কে পরাজিত করেন এবং হত্যা করেন। এ যুদ্ধে অনেক সাহাবী শহীদ হন। কেউ বলেন, এর সংখ্যা ছিল সাতশত। আবার কেউ বলেন, এর চাইতেও বেশি।
কুরআন সংকলনের ইতিহাস: ইমাম হাকিম (রহঃ) তার মুস্তাদরাক গ্রন্থে বলেন, কুরআন তিনটি পর্যাযে সংকলন করা হয়। একটি হল, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায়। তবে যে সংকলন বর্তমান সময়ে আমাদের নিকট আছে এটা নয়। তখন বিভিন্ন সূরা বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে লিখিত ছিল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে, অর্থাৎ- এক জায়গায় লিখা হয়নি এবং সূরার ধারাবাহিকতাও ঠিক ছিল না।
হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে কুরআন একটি মাসহাফে সংকলন না করার কারণ হলো তখন কোন আয়াতের হুকুম অথবা কোন আয়াতের তিলাওয়াত মানসূখের সম্ভাবনা ছিল। তাই যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করলেন তখন এরূপ নাসিখ নাযিল হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল এবং আল্লাহ খুলাফায়ে রাশিদীনদের ইলহাম করে কুরআন সংরক্ষণ করার জন্য নির্দেশ দেন। তাই সংকলনের সূচনা হয়েছিল ‘উমার (রাঃ)-এর পরামর্শক্রমে আবূ বাকর সিদ্দীক্বের হাত ধরে। আবূ বাকর (রাঃ) প্রথমত কুরআন সংকলন করতে চাননি। কিন্তু ‘উমার (রাঃ)-এর বারবার বলার কারণে তিনি এই মহান দায়িত্বের প্রতি মনোযোগ দেন। আর তিনি উপলব্ধি করেন যে, এটাই হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর কিতাব, তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাধারণ মানুষের খায়েরখাহী করা।
আবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশও রয়েছে। যেমন তিনি বলেন, (لا تكتبوا عني شيئاً غير القرآن)। আর আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে জানিয়ে দিয়েছেন যে, কুরআন একটি صفة-এ সংকলিত রয়েছে। যেমন আল্লাহর বাণীঃ يَتْلُو صُحُفًا مُطَهَّرَةً ‘‘যে পাঠ করে পবিত্র গ্রন্থ’’- (সূরা আল বাইয়্যিনাহ্ ৯৮ : ২)। কিন্তু এখন বিক্ষিপ্তভাবে পাথরে, খেজুরের ডালে, অনুরূপ বস্ত্ততে লিখা রয়েছে। অতঃপর তিনি একটি মুসহাফে সংকলন করলেন। এটাকে রাফিযী সম্প্রদায় সম্পূর্ণ বিদআত (বিদাত) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
হারিস মুহাসিব তার ‘‘ফাহামুস্ সুনান’’ গ্রন্থে বলেছেন, কুরআন লিখন বিদআত (বিদাত) নয়। কারণ, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন লিখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা বিভিন্ন কাগজের টুকরায়, খেজুরের ডালে, হাড্ডিতে। আবূ বাকর (রাঃ) এগুলোকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় একত্রিত করলেন। যেন তিনি বিক্ষিপ্ত কুরআনকে বিভিন্ন পাতায় স্থান দিলেন। যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। অতঃপর সেগুলোকে একটি সুতায় বেঁধে দিলেন যাতে কোন অংশ নষ্ট না হয়ে যায়। (ইত্ক্বান- ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫৮)
আবূ বাকর (রাঃ) ওহীর লেখক যায়দ বিন সাবিত-কে কুরআন লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব দেন। হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী যায়দ-এর চারটি বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করেছেন যা এই কাজের জন্য প্রয়োজন।
১. যুবক হওয়া- যে প্রত্যাশিত কিছু খুঁজতে আগ্রহী হবে।
২. জ্ঞানী হওয়া- যে সেগুলোকে সংরক্ষণ করবে।
৩. মিথ্যায় অভিযুক্ত না হওয়া- যাতে তার প্রতি আস্থা রাখা যায়।
৪. ওহীর লেখক ছিলেন- যিনি সর্বাধিক কুরআনের চর্চা করতেন।
যায়দ বিন সাবিত (রাঃ) অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কুরআন সংকলনের কাজ সম্পাদন করতে থাকেন। ইয়াহ্ইয়া বিন ‘আবদুর রহমান বলেন, ‘উমার (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, যে ব্যক্তি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে কুরআন শিখেছে সে যেন তা নিয়ে উপস্থিত হয়। তখন মানুষেরা কাগজের টুকরা, হাড্ডিতে মসৃন পাথরে কুরআন লিপিবদ্ধ করত। যায়দ (রাঃ) কারো নিকট থেকে দু’টি সাক্ষী না পাওয়া পর্যন্ত কিছু গ্রহণ করতেন না। এটা প্রমাণ করে যে, তিনি শুধুমাত্র কারো নিকট কিছু লিখিত পেলেই গ্রহণ করতেন না যতক্ষণ না তিনি জানতেন যে, কার নিকট থেকে শিখেছে এবং তিনি জানেন কি না? এক্ষেত্রে আবূ বাকরও সতর্কতা অবলম্বন করতেন। একদা তিনি যায়দ ও ‘উমারকে বললেন, তোমরা দু’জন মাসজিদের দরজায় বস এবং যে তোমাদের নিকটে দু’জন সাক্ষীসহ বলবে যে, এটা কুরআনের আয়াত তখন তা লিখে নাও। আর দুই সাক্ষী থেকে উদ্দেশ্য حفظ তথা মুখস্থ এবং كتابة তথা লিখিত।
অথবা এ দু’টি সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, এটা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে লিখিত।
অথবা এ দু’টি প্রমাণ করবে যে, এটা যেসব পদ্ধতিতে কুরআন নাযিল হয়েছে তারই অন্তর্ভুক্ত। শুধু মুখস্থের ভিত্তিতে নয়। এর সাথে লিখার উপর গুরুত্ব প্রদান করতেন। এজন্যই যায়দ সূরা আত্ তাওবার শেষের আয়াত সম্পর্কে বলেন, আমি আর কারো নিকটে লিখিত পায়নি।
সুয়ূত্বী (রহঃ) বলেন, এই দুই সাক্ষী থেকে উদ্দেশ্য হলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মারা যাওয়ার বছর কুরআনকে যে দু’বার জিবরীল নাবীর ওপর পড়ে শুনান সেটাই।
কুসতুলানী (রহঃ) বলেন, (صدور الرجال) এর অর্থ হলো যারা কুরআন সংকলন করেছেন এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে সম্পূর্ণ কুরআনকে মুখস্থ রেখেছেন। যেমন উবাই বিন কা‘ব, মু‘আয বিন জাবাল প্রভৃতি। আর হাড্ডিতে পাথরে লিখিত পাওয়া যেন স্থির করল আবার অনুমোদন দেয়া হলো। اللمعات-এ বলা হয়েছে (صدور الرجال) হলো নির্ভরযোগ্য উৎস।
আর كتابة হলো تقرير على تقرير। অন্য বর্ণনায় রয়েছে কুরআন সংকলন কারীগণ কারো নিকটে কুরআনের আয়াত পেলে তাকে কসম দিতেন অথবা কোন প্রমাণ তলব করতেন। মোট কথা এসব কঠোরতা অবলম্বন করেছেন সর্বাত্মক সতর্কতা অবলম্বনের জন্য।
যায়দ বিন সাবিত, ‘উমার, আবূ খুযায়মাহ্, উবাই বিন কা‘ব তাওবার শেষ আয়াত সংগ্রহ করে গোটা কুরআনকে একটি মাসহাফে সংকলন করেন, আবূ বাকর (রাঃ)-এর নিকট রেখে দেন। তার মৃত্যুর পর ‘উমার বিন খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর নিকট, অতঃপর তদীয় কন্যা হাফসাহ্’র নিকট কুরআনের মাসহাফটি থাকে।
২২২১
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২২১
وَعَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ: أَنَّ حُذَيْفَةَ بْنَ الْيَمَانِ قَدِمَ عَلٰى عُثْمَانَ وَكَانَ يُغَازِىْ أَهْلَ الشَّامِ فِىْ فَتْحِ أَرْمِينِيَّةَ وَأَذْرَبِيجَانَ مَعَ أَهْلِ الْعِرَاقِ فَأَفْزَعَ حُذَيْفَةَ اخْتِلَافُهُمْ فِى الْقِرَاءَةِ فَقَالَ حُذَيْفَةُ لِعُثْمَانَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ أَدْرِكْ هٰذِهِ الْأُمَّةَ قَبْلَ أَنْ يَخْتَلِفُوْا فِى الْكِتَابِ اخْتِلَافَ الْيَهُودِ وَالنَّصَارٰى فَأَرْسَلَ عُثْمَانُ إِلٰى حَفْصَةَ أَنْ أَرْسِلِىْ إِلَيْنَا بِالصُّحُفِ نَنْسَخُهَا فِى الْمَصَاحِفِ ثُمَّ نَرُدُّهَا إِلَيْكِ فَأَرْسَلَتْ بِهَا حَفْصَةُ إِلٰى عُثْمَانَ فَأَمَرَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ وَعَبْدَ اللّٰهِ بْنَ الزُّبَيْرِ وَسَعِيْدَ بْنَ الْعَاصِ وَعَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ الْحَارِثِ بْنِ هِشَامٍ فَنَسَخُوهَا فِى الْمَصَاحِفِ وَقَالَ عُثْمَانُ لِلرَّهْطِ الْقُرَشِيِّيْنَ الثَّلَاثِ إِذَا اخْتَلَفْتُمْ فِىْ شَىْءٍ مِنَ الْقُرْاٰنِ فَاكْتُبُوهُ بِلِسَانِ قُرَيْشٍ فَإِنَّمَا نَزَلَ بِلِسَانِهِمْ فَفَعَلُوا حَتّٰى اِذَا نَسَخُوا الصُّحُفَ فِى الْمَصَاحِفِ رَدَّ عُثْمَانُ الصُّحُفَ إِلٰى حَفْصَةَ وَأَرْسَلَ إِلٰى كُلِّ أُفُقٍ بِمُصْحَفٍ مِمَّا نَسَخُوْا وَأَمَرَ بِمَا سِوَاهُ مِنَ الْقُرْاٰنِ فِىْ كُلِّ صَحِيفَةٍ أَوْ مُصْحَفٍ أَنْ يُحْرَقَ قَالَ ابْنِ شِهَابٍ فَاَخْبَرَنِىْ خَارِجَةُ بْنُ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ سَمِعَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ قَالَ فَقَدْتُ اٰيَةً مِنَ الْأَحْزَابِ حِينَ نَسَخْنَا الْمُصْحَفَ قَدْ كُنْتُ أَسْمَعُ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ يَقْرَأُ بِهَا فَالْتَمَسْنَاهَا فَوَجَدْنَاهَا مَعَ خُزَيْمَةَ بْنِ ثَابِتٍ الْأَنْصَارِىِّ (مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا الله عَلَيْهِ) فَأَلْحَقْنَاهَا فِىْ سُورَتِهَا فِى الْمُصْحَفِ. رَوَاهُ الْبُخَارِىُّ
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, হুযায়ফাহ্ ইবনু ইয়ামান, খলীফা ‘উসমান (রাঃ)-এর কাছে মাদীনায় এলেন। তখন হুযায়ফাহ্ ইরাক্বীদের সাথে থেকে আরমীনিয়্যাহ্ (আরমেনিয়া) ও আযরাবীজান (আযারবাইজান) জয় করার জন্য শামবাসীদের (সিরিয়াবাসীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। এখানে তাদের অমিল কুরআন তিলাওয়াত তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। তিনি ‘উসমান (রাঃ)-কে বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! ইয়াহূদী-খৃষ্টানদের মতো আল্লাহর কিতাবে ভিন্নতা আসার আগে আপনি এ জাতিকে রক্ষা করুন। তাই ‘উসমান (রাঃ) উম্মুল মু’মিনীন হাফসাহ্’র নিকট রক্ষিত মাসহাফ (কুরআন মাজীদ) তার নিকট পাঠিয়ে দেবার জন্য খবর পাঠালেন। তিনি বললেন, আমরা সেটাকে বিভিন্ন মাসহাফে অনুলিপি করে আবার আপনার নিকট তা পাঠিয়ে দিব। হাফসাহ্ (রাঃ) সে সহীফাহ্ ‘উসমানের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। ‘উসমান (রাঃ) সাহাবী যায়দ ইবনু সাবিত, ‘আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র, সা‘ঈদ ইবনু ‘আস ও ‘আবদুল্লাহ ইবনু হারিস ইবনু হিশামকে এ সহীফা কপি করার নির্দেশ দিলেন।
হুকুম মতো তারা এ সহীফার অনেক কপি করে নিলেন। সে সময় ‘উসমান কুরায়শী তিন ব্যক্তিকে বলে দিয়েছিলেন, কুরআনের কোন স্থানে যায়দ-এর সাথে আপনাদের মতভেদ হলে তা কুরায়শদের রীতিতে লিখে নিবেন। কারণ কুরআন মূলত তাদের রীতিতেই নাযিল হয়েছে। তারা নির্দেশ মতো কাজ করলেন। সর্বশেষ সমস্ত সহীফাহ্ বিভিন্ন মাসহাফে কপি করে নেবার পর ‘উসমান মূল সহীফাহ্ হাফসাহ্’র নিকট ফেরত পাঠালেন। তাদের কপি করা সহীফাহসমূহের এক এক কপি রাজ্যের এক এক এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন। এ কপি ছাড়া অন্য সব আগের সহীফায় লিখিত কুরআনকে জ্বালিয়ে ফেলতে নির্দেশ জারী করেছিলেন।
ইবনু শিহাব যুহরী বলেন, যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ) এর ছেলে খারিজাহ্ আমাকে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর পিতা যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, আমরা যখন কুরআন নকল করি, সূরা আল আহযাব-এর একটি আয়াত খুঁজে পেলাম না। এ আয়াতটি আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পড়তে শুনেছি। তাই আমরা তা খোঁজ করতে লাগলাম। খুযায়মাহ্ ইবনু সাবিত আল আনসারী-এর নিকট অবশেষে আমরা তা পেলাম। এরপর আমরা তা মাসহাফে সংযোজন করে দিলাম। আর সে আয়াতটি হলো, ‘‘মিনাল মু’মিনীনা রিজা-লুন সদাকূ মা- ‘আ-হাদুল্ল-হা ‘আলায়হি’’ (অর্থাৎ- মু’মিনদের মধ্যে কতক লোক আল্লাহর সঙ্গে কৃত তাদের অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে)- (সূরা আল আহযাব ৩৩ : ২৩)। (বুখারী)[১]
রশাত্বীয়ু (রহঃ) বলেন, আরমেনিয়ার যুদ্ধ ‘উসমান (রাঃ)-এর খিলাফাতে ২৪ হিজরীতে সালমান বিন রবী‘আহ্-এর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়।
ইবনুল ‘আরাবী (রহঃ) বলেন, আযারবায়জান আরমেনিয়ার পাশের এলাকা। এ দু’টি যুদ্ধ একই বছরে সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে ইরাকবাসী ও সিরিয়াবাসী ভিন্ন ভিন্নভাবে কুরআন তিলাওয়াত করত। কোন বর্ণনায় এসেছে, ইরাকবাসী ‘আবদুল্লাহ বিন মাস্‘ঊদ (রাঃ)-এর কিরাআতে তিলাওয়াত করতেন। আর সিরিয়াবাসী উবাই বিন কা‘ব (রাঃ)-এর নিয়মানুসারে তিলাওয়াত করতো। এতে তাদের মাঝে যেন এক ধরনের ফিতনা শুরু হয়েছিল। ফলে তারা পরস্পরের তিলাওয়াতকে অস্বীকার করে বসত। একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, তারা উভয়ে وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلهِ [البقرة: 196] আয়াতকে নিয়ে মতানৈক্য করে। তাদের কেউ বলে وأتموا الحج والعمرة للبيت পড়লে হুযায়ফাহ্ রাগান্বিত হলেন। এমনকি তার চোখ লাল হয়ে গেল। তিনি বলেন, যদি আমি আমিরুল মু’মিনীনের নিকট যাই তবে আমি তাকে কুরআনকে একই কিরাআতের উপর একত্রিত করার জন্য অনুরোধ করব। কেননা এর দ্বারা কুরআন নিয়ে ইয়াহূদী নাসারাদের মতো এই উম্মাতগণ মতভেদে জড়িয়ে পড়বে। তাই ‘উসমান (রাঃ) হুযায়ফাহ্ (রাঃ)-এর অনুরোধ হাফসাহ্ বিনতু ‘উমার-এর নিকট আবূ বাকর-এর সংকলিত মাসহাফটি চেয়ে পাঠান। এরপর আনসারী সাহাবী যায়দ বিন সাবিত এবং কুরায়শ সাহাবী ‘আবদুল্লাহ বিন যুবায়র, সা‘ঈদ বিন ‘আস-কে দিয়ে লিখিয়ে নেন। কারণ যায়দ ছিলেন শ্রেষ্ঠ লেখক ও সা‘ঈদ ছিলেন স্পষ্টভাষী।
হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, ১২ জন সংকলকের মধ্যে ৯ জনকে আমরা চিনতাম। যাদের মধ্যে সূচনা হয়েছিল যায়দ ও সা‘ঈদ এর মাধ্যমে দিয়ে।
‘উসমান (রাঃ) তাদেরকে কুরায়শদের ভাষায় কুরআনকে লিখতে বলেন কুরায়শের সম্মান প্রকাশের জন্য। কারণ আল্লাহ বলেছেন, إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا ‘‘আমি ওটাকে (কুরআনকে) করেছি ‘আরাবী ভাষায়’’- (সূরা আয্ যুখরুফ ৪৩ : ৩)। ‘আরাবী ভাষা অনেক গোত্রের রয়েছে, যেমন কুরায়শ, মুযার, রবী‘আহ্ ইত্যাদি। তাই কোন গোত্রের সাথে নির্দিষ্ট করতে স্পষ্ট দলীলের দরকার হয়। অন্যথায় নির্দিষ্ট ভাবে বলা যাবে না। এ ব্যাখ্যাটি করেছেন কাযী আবূ বাকর ইবনু আল বাকিলানী।
আবূ শামাহ (রহঃ) বলেন, ‘উসমান কুরায়শ বংশের সাথে নির্দিষ্ট করার কারণ হলো সর্বপ্রথম কুরআন কুরায়শদের ভাষায় নাযিল হয়। এরপর সহজতর জন্য বা পড়ার সুবিধার জন্য সাত পদ্ধতিতে নাযিল হয়। যখন কুরআনকে একটি ভাষায় একত্রিত করলেন তখন এটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সাত রীতির মধ্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরায়শ বংশের ভাষা উত্তম। ফলে মানুষ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষা হওয়ায় আগ্রহের সাথে গ্রহণ করে। আসলে আবূ বাকর (রাঃ)-এর উদ্দেশ্য ছিল কুরআনকে সমস্ত শারী‘আত সম্মত রীতিতে সংকলন করা। আর ‘উসমানের কুরায়শের ভাষায় কুরআনকে সংকলন করার উদ্দেশ্য ছিল কুরআনের ব্যাপারে মানুষের মতভেদের রাস্তাকে বন্ধ করে দেয়া।
‘উসমান (রাঃ) হাফসাহ্’র নিকট থেকে প্রাপ্ত কপিগুলো থেকে লিখার পর আবার তার নিকটে ফেরত পাঠান এবং লিখিত পাণ্ডুলিপি ছাড়া অন্য সব পাণ্ডুলিপিকে পোড়ানোর নির্দেশ দেন। ইবনুল বাত্বাল (রহঃ) এ হাদীসকে লক্ষ্য করে বলেন, আল্লাহর নাম উল্লেখ আছে এমন বই-পত্র আগুনে পুড়িয়ে দেয়া জায়িয। এটাই হচ্ছে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং মানুষের পায়ে পদদলিত হওয়া থেকে রক্ষার উপায়।
ইবনু ‘আতিয়্যাহ্ বলেন, পাণ্ডুলিপি পুড়ানো সেই সময়ে প্রযোজ্য ছিল। তবে এখন প্রয়োজন হলে সেগুলোকে ধৌত করা উত্তম। হানাফীগণ বলেন, কোন কুরআনের মাসহাফ পুরাতন হওয়ার কারণে উপকৃত না হওয়া গেলে মানব চলাচলের রাস্তা থেকে দূরের কোন পবিত্র স্থানে পুঁতে দেয়া জায়িয। কারী বলেন, পুরাতন পাণ্ডুলিপি ধৌত করে পানিগুলোকে পান করতে হবে।
তিরমিযীর ব্যাখ্যাকার আমাদের বিজ্ঞ-পণ্ডিত ‘আল্লামা ‘আয়নী (রহঃ)-এর কথা নকল করে বলেন, যদি চিন্তা করা যায় তবে পুড়ানোই সর্বোত্তম পথ বলে মনে হবে। তাই ‘উসমান (রাঃ) পুড়িয়েছেন। তিনি আরো বলেন, পাণ্ডুলিপিকে ধৌত করা অসম্ভব। তাই এটা স্পষ্ট বিবেকবিরোধী মত।
আবূ বাকর (রাঃ)-এর যুগে সংকলনের সময়ে সূরা তাওবার দু’টি আয়াত পাওয়া যাচ্ছিল না। যা খুযায়মাহ্ বিন সাবিত-এর নিকটে পাওয়া গেল। আর ‘উসমানের এর যুগে সূরা আহযাব-এর একটি আয়াত পাওয়া যাচ্ছিল না। এরূপ মত ব্যক্ত করেছেন হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ)। তিনি আরো বলেন, উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বুঝতে পারা যায় যে, যায়দ বিন সাবিত কুরআন সংকলনের জন্য শুধু জানা বা মুখস্থ থাকার উপর নির্ভর করেননি বরং তিনি তাদের নিকট লিখা আছে কিনা লক্ষ্য করতেন।
২২২২
মিশকাতুল মাসাবিহ
অধ্যায় : পর্ব-৮ঃ কুরআনের মর্যাদা
হাদীস নং : ২২২২
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قُلْتُ لِعُثْمَانَ بْنِ عَفَّان : مَا حَمَلَكُمْ أَنْ عَمَدْتُمْ إِلَى الْأَنْفَالِ وَهِىَ مِنَ الْمَثَانِىْ وَإِلٰى بَرَاءَةٍ وَهِىَ مِنَ الْمَئِينِ فَقَرَنْتُمْ بَيْنَهُمَا وَلَمْ تَكْتبُوْا بَيْنَهُمَا سَطْرَ بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ وَوَضَعْتُمُوْهَا فِى السَّبْعٍ الطُّوَلِ مَا حَمَلَكُمْ عَلٰى ذٰلِكَ فَقَالَ عُثْمَانُ كَانَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ مِمَّا يَأْتِىْ عَلَيْهِ الزَّمَانُ وَهُوَ تُنْزِلُ عَلَيْهِ السُّوَرُ ذَوَاتُ الْعَدَدِ فَكَانَ إِذَا نَزَلَ عَلَيْهِ الشَّىْءٌ دَعَا بَعْضَ مَنْ كَانَ يَكْتُبُ فَيَقُولُ: «ضَعُوْا هَؤُلَاءِ الْاٰيَاتِ فِى السُّورَةِ الَّتِىْ يُذْكَرُ فِيهَا كَذَا وَكَذَا» فَإِذَا نَزَلَتْ عَلَيْهِ الْاٰيَةُ فَيَقُولُ: «ضَعُوْا هٰذِهِ الْاٰيَةَ فِى السُّورَةِ الَّتِىْ يُذْكَرُ فِيهَا كَذَا وَكَذَا». وَكَانَتِ الْأَنْفَالُ مِنْ أَوَائِلِ مَا نَزَلَتْ بِالْمَدِينَةِ وَكَانَتْ بَرَاءَةٌ مِنْ اٰخِرِ الْقُرْاٰنِ وَكَانَت قِصَّتُهَا شَبِيْهَةً بِقِصَّتِهَا، فَقُبِضَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ وَلَمْ يُبَيِّنْ لَنَا أَنَّهَا مِنْهَا فَمِنْ أَجْلِ ذٰلِكَ قَرَنْتُ بَيْنَهُمَا وَلِمَ أَكْتُبْ بَيْنَهُمَا سَطْرَ بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ وَوَضَعْتُهَا فِى السَّبْعِ الطُّوَلِ. رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِىُّ وَأَبُو دَاوُدَ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি একবার খলীফা ‘উসমানকে বললাম, কোন্ জিনিস আপনাদেরকে উদ্বুদ্ধ করল যে সূরা আনফাল, যা সূরা ‘মাসানী’র অন্তর্ভুক্ত, সূরা বারাআত (আত্ তাওবাহ্) যা ‘মাঈন’-এর অন্তর্ভুক্ত? এ উভয় সূরাকে এক স্থানে একত্র করে দিলেন? এ দু’ সূরার মাঝে আবার ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ লাইনও লিখলেন না? আর এগুলোকে জায়গা দিলেন ‘‘সাব্‘ইত্ব তুওয়াল’’-এর মধ্যে (অর্থাৎ- ৭টি দীর্ঘ সূরা)। কোন্ বিষয়ে আপনাদেরকে এ কাজ করতে উজ্জীবিত করল? ‘উসমান জবাবে বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর ওহী নাযিল হবার অবস্থা ছিল এমন যে, কোন কোন সময় দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হত (তাঁর ওপর কোন সূরা নাযিল হত না) আবার কোন কোন সময় তাঁর ওপর বিভিন্ন সূরা (একত্রে) নাযিল হত। তাঁর ওপর কুরআনের কিছু নাযিল হলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর কোন না কোন সাহাবী ওহী লেখককে (কাতিবে ওহী) ডেকে বলতেন, এ আয়াতগুলোকে অমুক সূরার অন্তর্ভুক্ত করো। যেসব আয়াতে অমুক অমুক বর্ণনা রয়েছে এর, আর অন্য কোন আয়াত নাযিল হলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলতেন, এ আয়াতকে অমুক সূরায় স্থান দাও।
মাদীনায় প্রথম নাযিল হওয়া সূরাহসমূহের মধ্যে সূরা আল আনফাল অন্তর্ভুক্ত। আর সূরা ‘বারাআত’ মাদীনায় অবতীর্ণ হবার দিক দিয়ে শেষ সূরাগুলোর অন্তর্গত। অথচ ও দু’টি সূরার বিষয়বস্ত্ত প্রায় এক। এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের কারণে আমাদেরকে বলে যেতে পারেননি সূরা বারাআত, সূরা আনফাল-এর অন্তর্ভুক্ত কিনা। তাই (অর্থাৎ- উভয় সূরা মাদানী ও বিষয়বস্ত্তর মিল থাকার কারণে) আমি এ দু’ সূরাকে একত্রে মিলিয়ে দিয়েছি। ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ লাইনও (এ দু’ সূরার মধ্যে) লিখিনি এবং এ কারণেই এটাকে ‘‘সাব্‘ইত্ব তুওয়াল’’-এর অন্তর্গত করে নিয়েছি। (আহমদ, তিরমিযী ও আবূ দাঊদ)[১]
কেউ কেউ বলেন, সূরা আনফাল ও তাওবার সমষ্টি হচ্ছে সপ্তম সূরা। এ সূরা দু’টি যেন একটি সূরা। এ কারণে এই দু’টি সূরার মাঝে بسم الله দ্বারা পার্থক্য করা হয়নি।
* দ্বিতীয় প্রকার হলো ذوات مائية অর্থাৎ- যেসব সূরায় ১০০ বা ১০০ এর কম বেশি আয়াত রয়েছে, এ ধরনের সূরার সংখ্যা ১১ টি। এর আরেক নাম المئون।
* তৃতীয় প্রকার হলো مثانى অর্থাৎ- যেসব সূরায় ১০০ এর কম আয়াত আছে। এ প্রকার সূরার সংখ্যা ২০ টি।
* চতুর্থ প্রকার হলো مفصل। আর এ নামে নামকরণের কারণ হলো بسم الله এর মাধ্যমে সূরাগুলোকে বেশি বেশি ভাগ করা হয়েছে।
ইবনু ‘আব্বাস ‘উসমান (রাঃ)-কে দু’টি প্রশ্ন করেছেন। (এক) আনফাল ছোট সূরা হওয়া সত্ত্বেও কেন الطول-এ এবং সূরা তাওবাকে طول -এর সমপর্যায়ের হওয়া সত্ত্বেও مئين এ আর দু’টির মাঝে بسم الله কেন লেখা হল না।
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) এর দু’টি প্রশ্নের জবাব ‘উসমান (রাঃ) প্রদান করেছেন, কারণ দু’টি বিষয়ের মাঝে সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা তিনি মনে করেছেন যে, সূরা দু’টি একটিই সূরা। তাই এটাকে السبع الطول এর মাঝে রাখা হয়েছে। আর এ দু’টির মাঝে بسم الله লেখা হয়নি।
অথবা দু’টি সূরা মনে করেছেন, তাই এ দু’টির মাঝে ফাঁকা সাদা জায়গা রাখা হয়েছে। এ ধরনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এটা সাদৃশ্য হওয়া বা অস্পষ্ট হওয়ায় এবং এ দু’টির একটি সূরা হওয়াতে অকাট্য প্রমাণ না থাকায়।
বর্তমানে কুরআনে যে অবস্থায় সূরার ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে এটা আল্লাহ কর্তৃক জিবরীল মারফত প্রাপ্ত না সাহাবীদের ইজতিহাদের মাধ্যমে হয়েছে, এ ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে।
কেউ কেউ বলেন, এটা সাহাবীদের ইজতিহাদের মাধ্যমে। এ মতের প্রবক্তাদের মধ্যে কাযী আবূ বাকর (রহঃ) অন্যতম। তারা এ মতের প্রতি ঝুঁকেছেন এজন্যে যে, সাহাবীদের কুরআন নাযিলের কারণ এবং শব্দাবলীর অবস্থান স্থল সম্পর্কে জ্ঞান ছিল। মূলত তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে যা শুনতেন তা লিখে রাখতেন।
আবার কেউ বলেন, আয়াতের ধারাবাহিকতা ও সূরার ধারাবাহিকতা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিধান।
ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) তাঁর مدخل গ্রন্থে বলেছেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে সূরা আনফাল ও তাওবাহ্ ব্যতীত অন্য সব আয়াত ও সূরা এ ধারাতেই সাজানো ছিল। যা ‘উসমান (রাঃ) এর হাদীস থেকে বুঝা যাচ্ছে। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী ও ‘উলামাগণের বিস্তারিত মতভেদের বর্ণনা উল্লেখ পূর্বক ইমাম বায়হাক্বীর মত সমর্থন করে ‘আলিমদের মতামতকে উল্লেখ করে বলেন, সূরা আনফাল ও তাওবাহ্ ছাড়া সমস্ত সূরার তারতীব আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত।
নির্ভরযোগ্য ও অগ্রাধিকারযোগ্য মত: ইমাম বাগাবী, ইবনুল আবারী, কিরমানী ও অন্যান্যদের মত হচ্ছে আমাদের সিদ্ধান্ত। তাদের মত হলো বর্তমানে কুরআনে সূরার এবং আয়াতের যে ধারাবাহিকতা রয়েছে এভাবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পাদন করেছেন। যেমন জিবরীল (আঃ) আল্লাহর নিকট থেকে সংবাদ পেয়েছেন। সুতরাং সমস্ত সূরার ধারাবাহিকতা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর এর বিপক্ষে যেসব মত রয়েছে তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য।
তিরমিযী ও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে যে, মাদীনায় প্রথমদিকে সূরা আল আনফাল নাযিল হয়েছে এবং সূরা আত্ তাওবাহ্ কুরআন নাযিলের শেষের দিকে নাযিল হয়েছে।
কারী বলেন, সূরা আত্ তাওবাহ্ মাদানী সূরা। এ দু’টি সূরার মাঝে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিক বিষয়বস্ত্তর সাদৃশ্য রয়েছে। আর এটাই হচ্ছে দু’টি সূরাকে একত্রিত করার একটি কারণ।
মোটকথা দু’টি সূরা হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট দলীল না আসায় بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ উল্লেখ করা হয়নি, একটি সূরা হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট না পাওয়ায় ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে। আর দু’টি সূরা হলেও طول-এ রাখা বেঠিক হয়নি। কারণ مئين-এর ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন সূরা র‘দ এবং সূরা ইব্রাহীম। আর যদি একটি সূরা হয় তাহলে তাকে সেখানে রাখা ঠিক হয়েছে। যাকে مثانى-এর স্থানে দিলে তা ঠিক হতো না ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো না । তাই সাদৃশ্য থাকার কারণে طول-এর শেষে এবং مئين-এর প্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে।